TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

হাসিনার ‘রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেল’ আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি ভুল পদক্ষেপ

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের একটি বড় অংশ ভারতে কেবল আশ্রয়ই নেয়নি, তারা মনে হচ্ছে অনুপ্রেরণাও নিচ্ছেন দেশটির প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের কাছ থেকে। ভারতের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে যেমন হাসিনা নিজ দেশে ব্যাপক অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছেন, এবার ভারতীয় রাজনীতির ছাঁচ অনুসরণ করলে বাংলাদেশিদের কাছে আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা ফেরার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার কথা। এরই মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন কে, তা নিয়ে দলে গভীর চিন্তাভাবনা চলছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তবে তাতে দমে না গিয়ে দলটি নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ‘রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেল’ নিয়ে ভাবছে। ভারতে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেল কতটা কার্যকর, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে বাংলাদেশে, বিশেষত ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর যেভাবে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলেন, সেই প্রেক্ষাপটে এই ফর্মুলা কার্যকর হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।

৮ই সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, কংগ্রেসের মতো পারিবারিক নেতৃত্বের ধাঁচে আওয়ামী লীগকে সাজাতে চাইছেন হাসিনা। যেমন কংগ্রেসে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সংসদে আছেন, ঠিক তেমনি তার ছেলে-মেয়েকে সামনে আনতে চাইছেন হাসিনা। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় (৫৪) বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তিনি আওয়ামী লীগের কার্যত মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান তুলে ধরছেন। অন্যদিকে, হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল (৫২) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন। তিনি দলের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামলাচ্ছেন। বক্তৃতা লেখা, রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিকল্পনা করা ও কূটনৈতিক বৈঠকে মায়ের প্রতিনিধিত্ব করা- এসব দায়িত্বে তিনি সক্রিয়। হাসিনার ভাগিনা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও হাসিনার সন্তানদের সহায়তায় থাকবেন বলে জানা গেছে।

প্রতিবেদনটি আরও জানায়, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসছে। ৫ই আগস্ট ২০২৪ সালে হাসিনা সরকারের পতনের আগে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখ ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি এখনও দলের সাধারণ সম্পাদক হলেও, ভারত পালানোর পর থেকে হাসিনার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি। হাসিনার নতুন ঘনিষ্ঠ মহলে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক এমপি ও বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম এবং সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। কলকাতায় একটি অস্থায়ী কার্যালয় থেকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম চলছে, আর দিল্লিতে গিয়ে তারা হাসিনার সঙ্গে পরামর্শ করেন। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ মহলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হচ্ছে যে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে হাসিনা পরিবারের পুরোনো সম্পর্কই তাকে সন্তানদের হাতে দল ছেড়ে দেয়ার দিকে প্রলুব্ধ করছে। রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-কেও তিনি প্রশংসা করেছেন এবং এর প্রভাব দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। রাহুল-প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক পথচলা নিয়েও তার আগ্রহ রয়েছে, যা আওয়ামী লীগে প্রয়োগ করতে তিনি মনস্থ করেছেন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগগুলির একটি ছিল ব্যাপক দুর্নীতি, যার সুবিধাভোগী ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। যদিও ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব শুরু হয় সরকারি চাকরিতে কোটার ইস্যুতে, পরে তা রূপ নেয় হাসিনা সরকারবিরোধী জনঅভ্যুত্থানে- যা আসলে প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাহ্য করা ‘বংশপরম্পরাগত শাসন’-এর বিরুদ্ধে ছিল। ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে খবর আসে- হাসিনা, তার ছেলে জয়, মেয়ে পুতুল ও আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ভূমি সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় তিনটি ভিন্ন ঘটনায় পাঁচজন সাক্ষ্য দিয়েছেন।

যুক্তি দেয়া যায়, এ ধরনের কিছু মামলা হয়তো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে জনগণের রাগ-ক্ষোভ যে হাসিনা পরিবারের দিকেই, তা অস্বীকার করা যায় না।
হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই ক্ষুব্ধ জনতা কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙেনি, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটিও ধ্বংস করেছে- যেটি তার স্মৃতিসৌধ হিসেবে ছিল। সেখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যা করা হয়। এতটাই ছিল মানুষের ক্ষোভ যে তারা জাতির পিতাকেও জাতীয় স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হাসিনার সন্তানের হাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত কতটা বুদ্ধিমানের কাজ?

বাংলাদেশি হিন্দু অধিকারকর্মী রূপন গুহ দ্য প্রিন্টকে বলেন, দেশকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরতে হবে- যখন মানুষ সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা অতিক্রম করে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে এক হয়েছিল। তার মতে, জয় ও পুতুল শিক্ষিত, যোগ্য এবং ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন। তারা নেতৃত্বের জন্য ভালো পছন্দ হতে পারেন। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশ কমিউনালিজম ও আইনহীনতার মধ্যে ডুবে আছে। তবে ভারতের কেআরইএ ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরাল ফেলো বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ শারিন শাহজাহান নাওমি মনে করেন, মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতে অভিজ্ঞতার অভাব জয়-পুতুলের জন্য বড় সমস্যা হতে পারে। তার মতে, তারা আওয়ামী লীগের অনেক স্টেকহোল্ডারের একজন হতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণেরা এখন এমন নেতৃত্ব চান যারা মাঠে কাজ করেছেন, মানুষের সঙ্গে মিশেছেন- কেবল অতীতের বোঝা নিয়ে আসা কারও নয়।

দ্য ডিপ্লোম্যাট-এর বাংলাদেশ সংবাদদাতা সাকলাইন রিজভে বলেন, জয়-পুতুলকে রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেলের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কারণ ভারতে কখনো গণঅভ্যুত্থানে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়নি। অথচ হাসিনা দুর্নীতি, গুম এবং গণহত্যার দায়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তার সন্তানরা কি সেই উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হতে পারবেন?

যদি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়ও, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে দলটি কিছুদিন ক্ষমতার বাইরে থাকবে। এই সময় দলীয় নেতৃত্বের উচিত নতুন রাজনৈতিক মডেল তৈরি করা, যা তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষণ করবে। যে বংশানুক্রমিক রাজনীতির বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছিল, সেই রাজনীতিতে ফিরে গেলে কোনো লাভ হবে না।

(দীপ হালদার একজন লেখক ও সাংবাদিক। তার এই লেখাটি অনলাইন দ্য প্রিন্ট থেকে অনুবাদ করা।)

সূত্রঃ দ্য প্রিন্ট

এম.কে
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আরো পড়ুন

পোশাকের রপ্তানিতে বাংলাদেশের নতুন রেকর্ড

যুক্তরাষ্ট্রে যেতে দেওয়া হয়নি চিত্রনায়ক রিয়াজকে

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তদের নাম ঘোষণা

নিউজ ডেস্ক