গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে যত বাংলাদেশি নাগরিক ধরা পড়েছেন, তাদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি বলে জানিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।
এর আগের দুই বছর একই সময়ের তুলনায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা সামান্য বেড়েছে, তবে পুরো বছরের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে অনুপ্রবেশ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়েনি বলে জানিয়েছে বিএসএফ।
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, যেসব হিন্দু বাংলাদেশি নাগরিক অবৈধ উপায়ে ভারতে আসতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার ও সহিংসতার কারণে দেশ ছেড়ে এসেছেন, এমনটা জানিয়েছেন সামান্য কিছু মানুষ।
বিবিসি যে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পেয়েছে, তা বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তের হলেও বাহিনীর পূর্ব কম্যান্ড–অর্থাৎ ভারত আর বাংলাদেশের পুরো সীমান্ত অঞ্চলের ছবিটা একই, এমনটাই জানিয়েছেন বাহিনীর একাধিক অফিসার।
বিশ্লেষকরা এ তথ্য পেয়ে কিছুটা বিস্মিত, কারণ বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ‘অত্যাচার’ এবং ‘সহিংসতা’র ঘটনায় বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারতে চলে আসছেন বা আসার চেষ্টা করছেন, এমনই একটা ন্যারেটিভ বা আখ্যান ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর তরফে দেওয়া হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে।
বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের সূত্রে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এ বছরের আগস্ট মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭১৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক অবৈধ ভাবে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে ধরা পড়েছেন।
এদের ধর্মীয় পরিচয় থেকে জানা যায়, তাদের মধ্যে ৩০১ জন হিন্দু এবং ৪১৫ জন মুসলমান।
তবে, কর্মকর্তারা এটাও বলছেন, পুরো বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাবে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের সময়কালে অনুপ্রবেশের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য কোনো বদল ঘটেনি।
হিন্দু এবং সব ধরনের অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা সামান্যই বেড়েছে বলে জানাচ্ছে বিএসএফের সূত্রগুলো।
বিগত দুই বছরের আগাস্ট থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ধরা পড়া অনুপ্রবেশকারীদের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে ২০৩ জন হিন্দু এবং ৪৪৯ জন মুসলমান ধরা পড়েছিলেন দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলে।
আবার তার আগের বছর, ২০২২ সালে আগাস্ট থেকে ডিসেম্বরে ১১৪ জন হিন্দু এবং ২৯৮ জন মুসলিম অবৈধ ভাবে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপরে কথিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সরব ভারতীয় সংগঠন ‘ক্যাম্ব’-এর আহ্বায়ক মোহিত রায় বিবিসিকে জানাচ্ছিলেন, চিরকালই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯৯২ সালে একটা প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে প্রতি একজন হিন্দু অনুপ্রবেশকারী-পিছু আড়াইজন মুসলমান অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসেন। এটা সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছিলেন ওই প্রবন্ধে, বলছেন মি রায়।
আবার এটাও ঘটনা অনেক অনুপ্রবেশকারী সীমান্ত রক্ষীদের হাতে ধরা না পড়েও ভারতে প্রবেশ করতে সক্ষম হন।
ধৃত অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা থেকে এই উপসংহার টানা যায় না যে শুধুমাত্র ওপরে উল্লেখিত সংখ্যক মানুষই কেবল অনুপ্রবেশ করেছেন।
বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলে যত জন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছেন এবছর আগস্টের পর থেকে, তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী।
বিএসএফ সূত্রগুলো বলছে বাংলাদেশে তাদের ওপরে নির্যাতন বা অত্যাচার হয়েছে বা হওয়ার আশঙ্কা করছেন, এবং সেই কারণেই তারা ভারতে চলে এসেছেন, এমন হিন্দু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
সেই সংখ্যাটা ধৃত অনুপ্রবেশকারীদের মাত্রই এক থেকে দুই শতাংশ।
এক সিনিয়র বিএসএফ কর্মকর্তা বলছেন, আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশিদের খুবই কম ভিসা দিচ্ছে ভারতীয় হাই কমিশন। তবে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেই ভারতের এই অঞ্চলে ব্যবসা, পারিবারিক বা নানা প্রয়োজনে আসতে হয়।
আগস্ট মাসের পর থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা বেশি, হিন্দুরা কম – এই পরিসংখ্যান কিছুটা বিস্মিত করেছে বিশ্লেষক এবং অ্যাক্টিভিস্টদের।
ভারতের সংগঠন ‘কমিটি এগেইনস্ট অ্যাট্রসিটিজ অন মাইনরিটিস ইন বাংলাদেশ’ বা ‘ক্যাম্ব’-এর আহ্বায়ক মোহিত রায় এই পরিসংখ্যানের কথা শুনে বলছিলেন, যে যারা অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন – তারা ‘আসল কারণ’টা চেপে যাচ্ছেন না তো!
যারা সীমান্ত পার করেন অবৈধভাবে, তার কারণ হিসাবে যা বলে থাকেন, অনেক সময়েই দেখা যায় যে কারা কোথায়, কী পরিস্থিতিতে প্রশ্নগুলো করছে, তার ওপরে নির্ভর করে তাদের জবাবগুলো।
কোন উত্তরটা দিলে তাদের সুবিধা হতে পারে, সেরকমই উত্তর দিয়ে থাকেন, আসল কারণ হয়তো চেপে যাচ্ছেন। তবে এটা খুবই অস্বাভাবিক তথ্য যে খুব কম সংখ্যক হিন্দু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তাদের ভারতে চলে আসার কারণ হিসাবে উল্লেখ করছেন না, বলছিলেন মি. রায়।
তার কথায়, ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ থেকে এমন অনেক হিন্দু নাগরিকের ফোন তিনি পেয়েছেন, যারা উদ্বিগ্ন হয়ে ভারতে চলে আসার কথা ভাবছেন।
একজন তো ভিসা নিয়ে ভারতে এসেও আবার ফিরে গেছেন। তিনি বলছেন ভারতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নিতে পারলেও সে সব চেক করলেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এদেশে। সেই আশঙ্কাতেই তিনি আবারও বাংলাদেশে ফিরে গেছেন, জানাচ্ছিলেন মোহিত রায়।
ভারতে গত কয়েক মাস ধরে একটা প্রচারণা এবং আখ্যান চলছে যে বাংলাদেশের হিন্দুরা ‘নির্যাতন’-এর শিকার হয়ে ভারতে চলে আসতে চাইছেন।
সেই প্রেক্ষাপটে অনুপ্রবেশকারীদের এরকম একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, যার ফলে ওই আখ্যান এবং প্রচারটাই কিছুটা নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য।
তার কথায়, দুই দেশের রাজনীতিবিদদের একাংশ তো ঢালাও ভাবে বলে চলেছিলেন সেই অগাস্ট মাস থেকে যে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ব্যাপক অত্যাচার হচ্ছে। তাই দলে দলে হিন্দুরা ভারতে চলে আসছে বা আসার কথা ভাবছে।
এই প্রচারটা বিশেষত চলছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম-সহ বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্যগুলোতে। পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬-এর নির্বাচনকে মাথায় রেখে এই প্রচারের তীব্রতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখন বিএসএফের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তো সামান্য সংখ্যক হিন্দুকেই সীমান্তে ধরা পড়তে দেখা যাচ্ছে।
মাত্রই কয়েকশো ধরা পড়েছেন এখানে। তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে অনেকে হয়ত ধরা না পড়েই অবৈধভাবে সীমান্ত পেরোতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সংখ্যা কত আমরা জানি না, যদি আরও বেশি হয়, বিএসএফ তার দায় এড়াতে পারে না! কিন্তু ব্যাপক হিন্দু পলায়নের হিন্দুত্ববাদী আখ্যানটা তো নস্যাৎ করে দিচ্ছে এই সংখ্যা, বলছিলেন মি. ভট্টাচার্য।
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি
এম.কে
০১ জানুয়ারি ২০২৫