যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় অমানবিক আচরণের অভিযোগ তীব্র হচ্ছে। বিশেষ সামরিক ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন অসংখ্য বাংলাদেশি; যারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আটক কেন্দ্র থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পুরো যাত্রাই ছিল ভয়ঙ্কর অবমাননা, নির্যাতন ও মানবিক মর্যাদাহানির উদাহরণ।
সম্প্রতি ফেরত পাঠানো এক বাংলাদেশি, যিনি নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছেন, জানান—বিমানবন্দরে নামার আগে টানা ৭৫ ঘণ্টা হাতে, পায়ে ও কোমরে ডান্ডাবেড়ি পরে থাকতে হয়েছে তাকে। এমনকি বাথরুমে যাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। তার শরীরে এখনও শেকলের দাগ স্পষ্ট। তিনি বলেন, “মানুষ তো দূরের কথা, পশুপাখিকেও এমন খাবার দেয় না।”
যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ বছর ধরে বৈধ হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন এই যুবক। বলিভিয়া থেকে দালালের মাধ্যমে মেক্সিকো হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করলেও আশ্রয় ও ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন বারবার বাতিল হয়। প্রশাসনের পরিবর্তনের পর কঠোর নজরদারির ফলে নিউইয়র্কে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং একাধিক ডিটেনশন সেন্টার ঘুরে শেষ পর্যন্ত লুইসিয়ানার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়—হাতে-পায়ে শেকল পরানো অবস্থায়।
একই ফ্লাইটে থাকা অন্য এক যাত্রীর বর্ণনাও ভয়াবহ। তিনি বলেন, রাত ১২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত শেকল পরানো অবস্থায় অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং তার পরেও ২৭–২৮ ঘণ্টা বিমানে শেকল খুলতে দেওয়া হয়নি। নোয়াখালীর বেশ কয়েকজন যাত্রী একই অভিজ্ঞতা জানান—“৪০ ঘণ্টা পর গার্বেজের মতো ফেলে গেছে দেশে।”
ফেরত আসা অনেকেই জানাচ্ছেন, বৈধ কাজের পারমিট নিয়ে ব্রাজিল বা অন্য দেশে গিয়েও দালাল চক্রের প্রলোভনে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ প্রবেশের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এতে ব্যয় হয়েছে ৩০–৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। একাধিক পরিবার বলেছে, সন্তানদের জন্য জমিজমা বিক্রি করে টাকা জোগাড় করলেও এখন সব হারিয়ে তারা নিঃস্ব।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টারের তথ্যমতে, গত সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে ২৫০ জনেরও বেশি বাংলাদেশিকে। এদের বেশিরভাগই নোয়াখালীর, পাশাপাশি সিলেট, ফেনী, শরিয়তপুর, কুমিল্লার অনেকেই রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আরও অনেক বাংলাদেশি আটক আছেন—যাদেরও ফেরত পাঠানো হতে পারে।
মার্কিন আইন অনুযায়ী কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের আদালতের রায় বা প্রশাসনিক নির্দেশে ফেরত পাঠানো যায়। কিন্তু শেকল পরিয়ে দীর্ঘ সময় আটক রাখা, বাথরুমে না যেতে দেওয়া, ন্যূনতম মানবিক সুবিধা না দেওয়া—এসব আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে অভিবাসী ধরপাকড় আরও জোরদার হয়েছে। কিন্তু মানবিক আচরণ কোনভাবেই বাদ দেওয়া যায় না—“৫০–৬০ ঘণ্টা শেকল পরে থাকা একজন মানুষের মধ্যে গভীর ট্রমা তৈরি করে।”
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করা—“অনিয়মে থাকলে ফেরত পাঠানো হোক, কিন্তু মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।”
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধ পারমিটে অন্য দেশে গিয়ে সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ প্রবেশের চেষ্টার প্রবণতা বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য বড় হুমকি। ব্রাজিলসহ নতুন শ্রমবাজার খুললেও কর্মীদের গতিপথ পর্যবেক্ষণ জরুরি; নাহলে এসব দেশও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ২৮ নভেম্বর ৩৯ জন, ৮ জুন ৪২ জন এবং মার্চ–এপ্রিলের বিভিন্ন ফ্লাইটে আরও অন্তত ৩৪ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি ইতোমধ্যে ২৫০ ছাড়িয়েছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন—বাংলাদেশ থেকে যারা বৈধভাবে কাজের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যান, তাদের গন্তব্য, কাজ পাওয়া, অবৈধ রুটে সরে যাওয়ার ঝুঁকি—এসব বিষয়ে সরকার ও এজেন্সিগুলোর কার্যকর নজরদারি না থাকলে দেশের শ্রমবাজারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা
এম.কে

