বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকাররে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। এতে বলা হয়েছে, মনে হচ্ছে দেশ এখনও অস্থির অবস্থায় রয়েছে। ড. ইউনূস এখনও ব্যাপকভাবে সম্মানিত হলেও তার শাসনক্ষমতা এবং প্রতিশ্রুত সংস্কারের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সোমবার (১০ মার্চ) প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি থেকে শুরু নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডের কথা উঠে এসেছে। ইউনূস কথা বলেছেন, দেশের অর্থনীতি, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এবং দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর নিয়ে। বাংলা ট্রিবিউন পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন গত আগস্টে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তখন তাকে স্বাগত জানায় বিধ্বস্ত এক দেশ। রাস্তাগুলো তখনও রক্তে লাল, মর্গে স্তূপ করা ছিল হাজারো প্রতিবাদী ও শিশুর লাশ, যাদের গুলি করে হত্যা করেছিল পুলিশ। ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর ছাত্রনেতৃত্বাধীন এক বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। নাগরিকদের প্রতিশোধের ভয়ে হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন তিনি।
দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ধারণার জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া ৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে তিনি রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচিত হন এবং বছরের পর বছর অপপ্রচার ও নিপীড়নের শিকার হন। বেশিরভাগ সময় তিনি বিদেশে কাটিয়েছেন। কিন্তু যখন ছাত্র প্রতিবাদীরা তাকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানায়, তিনি রাজি হন।
ইউনূস দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা যে ক্ষতি করেছেন, তা বিশাল। এটি একটি সম্পূর্ণ ধ্বসংপ্রাপ্ত দেশ ছিল, যেন আরেকটি গাজা। তবে এখানে ভবন নয়, পুরো প্রতিষ্ঠান, নীতি, মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ধ্বংস করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনার শাসনামল জুড়ে নির্যাতন, সহিংসতা ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। জুলাই ও আগস্ট মাসের রক্তাক্ত কয়েক সপ্তাহে তার দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়। জাতিসংঘের মতে পুলিশের এই সহিংস দমননীতি ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হতে পারে। তবে শেখ হাসিনা সব ধরনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ইউনূসের বাংলাদেশে ফেরাকে দেশটির নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখা হয়েছিল। দায়িত্ব নেওয়ার পর ছয় মাসে শেখ হাসিনার আশ্রয়হীন বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সমালোচকদের নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ ওঠা গোপন আটককেন্দ্রগুলো খালি করা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ আনা হয়েছে, যা তিনি অস্বীকার করেছেন। ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে দশকের মধ্যে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবে, এরপর তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
তবে ঢাকার রাস্তায় হাঁটলে মনে হয় দেশটি এখনও এক অস্থির অবস্থায় রয়েছে। যদিও ইউনূস এখনও ব্যাপকভাবে সম্মানিত, তার শাসনক্ষমতা এবং প্রতিশ্রুত সংস্কারের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় ফিরতে আগ্রহী এবং ইউনূসের ওপর নির্বাচন দ্রুত আয়োজনের জন্য চাপ বাড়াচ্ছে, যা তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররাও তাদের নিজস্ব দল গঠন করেছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতা আমির চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন যত দ্রুত সম্ভব আয়োজন করা উচিত। তিনি বলেন, ‘এই সরকার শুধু একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ছিল। এখন কেউই দৈনন্দিন ভিত্তিতে জবাবদিহি করছে না এবং তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব, ম্যান্ডেট ও সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য জনসমর্থন নেই।’
শেখ হাসিনার শাসনামলে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য জনরোষ ও ফৌজদারি অভিযোগের মুখে পুলিশ তাদের দায়িত্বে ফিরতে অনিচ্ছুক। এতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় গুন্ডাবাহিনীর অপরাধ বেড়েছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হয়রানি বেড়েছে। বাড়তে থাকা অপরাধ রোধে ব্যর্থতার অভিযোগে সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করে তার কুশপুতুল পোড়ায় বিক্ষোভকারীরা।
ইউনূস শেখ হাসিনার শাসনামলের তুলনায় রাস্তাগুলো কম নিরাপদ বলে কোনও ইঙ্গিতের কথা অস্বীকার করেছেন। তবে অন্যরা সতর্ক করেছেন যে, দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান ও বিশিষ্ট ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা অসম্ভব।’
গত সপ্তাহে এক কঠোর ভাষণের মধ্যে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, দেশটি ‘অরাজকতার অবস্থায়’ রয়েছে এবং যদি অস্থিরতা অব্যাহত থাকে, তবে ‘দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে’। ইউনূস দাবি করেছেন যে, সেনাবাহিনীর সাথে তার ‘খুব ভালো সম্পর্ক’ রয়েছে এবং সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে কোনও চাপ নেই। তবে কেউ কেউ জেনারেলের কথাকে ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি কঠোর সমালোচনা; এমনকি সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
ইউনূস দেশের সমস্যাগুলোকে শেখ হাসিনার শাসনের ফলাফল হিসেবে দেখাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসন কোনও সরকার ছিল না, এটি ছিল একদল ডাকাতের পরিবার। ওপর মহলের আদেশ পেলেই কাজ হতো। কেউ সমস্যা সৃষ্টি করছে? আমরা তাকে গায়েব করে দেব। নির্বাচন করতে চান? আমরা নিশ্চিত করব যে আপনি সব আসনে জিতবেন। টাকা চান? ব্যাংক থেকে দশ লাখ ডলার ঋণ নিন, যা ফেরত দিতে হবে না।’
শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতির মাত্রা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। তার আত্মীয়দের মধ্যে যারা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন তার ভাইঝি টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সংসদ সদস্য। বাংলাদেশে দুর্নীতির তদন্তে তার নাম উঠে আসার পর তিনি ট্রেজারি থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি সব ধরনের অসদাচরণ অস্বীকার করেছেন।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের আর্থিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলমান অভিযানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার মিত্রদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে নেওয়া আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন ডলার উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তবে শিগগিরই এই অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা কমে যাচ্ছে।
ইউনূস বলেন, ‘সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণে ব্যাংকগুলোকে লুটপাটের পূর্ণ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তারা তাদের কর্মকর্তাদের বন্দুক নিয়ে পাঠাতো সবকিছু অনুমোদন করাতে।’
ইউনূসের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কট্টর ইসলামপন্থি ধর্মীয় ডানপন্থার উত্থান রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগও করা হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামি দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং ইসলামি রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাপক নিপীড়ন করা হয়েছিল। তারা এখন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে এবং সমর্থন বেড়েছে, পাশাপাশি নিষিদ্ধ ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় কট্টর ইসলামি গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের পর কিশোরী মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে এবং শুক্রবার নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের শত শত সদস্যকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। ঢাকায় ইসলামিক খিলাফত দাবি করে মিছিল করছিল গোষ্ঠীটির সদস্যরা।
ইউনূসের ওপর কিছু চাপ বাংলাদেশের বাইরে থেকেও এসেছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপভোগ করতেন এবং এখন দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটায় প্রতিবেশী দেশটিতে আত্মগোপন করে আছেন। ইউনূসের নেতৃত্বে ভারত এই সম্পর্ক মেরামত করতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না এবং সম্প্রতি দিল্লি ঢাকাকে ‘সন্ত্রাসবাদকে স্বাভাবিকীকরণ’ করার অভিযোগ করেছে।
ডিসেম্বরে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণ অনুরোধ করা হয়েছিল, তবে ইউনূস নিশ্চিত করেছেন যে, ভারত সরকারের কাছ থেকে ‘কোনও সাড়া’ আসেনি। তিনি বলেছেন, হাসিনা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হবেন, এমনকি যদি তা অনুপস্থিতিতেও হয়।
শেখ হাসিনা ইউনূসের সমালোচনায় আরও সোচ্চার হয়ে উঠছেন: তিনি সম্প্রতি তাকে ‘গুন্ডা’ বলে অভিহিত করেছেন। তার দাবি, ইউনূস দেশে ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ ছেড়ে দিচ্ছেন।
ইউনূস বলেছেন, ভারত তাকে আশ্রয় দিলে তা সহ্য করা হবে, কিন্তু ‘তিনি আমাদের করা সবকিছু বাতিল করার চেষ্টা করতে ভারতকে তার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া, বিপজ্জনক। এটি দেশটিকে অস্থিতিশীল করে তোলে’।
ভারত সরকারই ইউনুসের একমাত্র সমস্যা নয়: ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে ফেরাও তার জন্য খারাপ খবর। বাইডেন প্রশাসন ইউনূসের সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিল– রাজনৈতিক ও আর্থিক উভয় দিক থেকেই। তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ট্রাম্পের অগ্রাধিকার হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ইউনূস সম্প্রতি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে তার স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, মাস্কের এপ্রিলে বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা রয়েছে।
ইউনূস আশা প্রকাশ করেছেন যে, ট্রাম্প বাংলাদেশকে একটি ‘ভালো বিনিয়োগের সুযোগ’ এবং বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে দেখতে পারেন এবং তিনি মাস্কের সফরের সময় তাকে এই প্রস্তাব দিতে চান। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী, তাই আমি তাকে বলি: আসুন, আমাদের সঙ্গে চুক্তি করুন।’
ইউনূস বলেছেন, ‘যদি তিনি তা না করেন, বাংলাদেশ কিছুটা মনোক্ষুণ্ন হবে। তবে এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেমে থাকবে না।’
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
১০ মার্চ ২০২৫