তৃতীয় দেশে অভিবাসন ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলবেনিয়ার সঙ্গে করা ইটালির চুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত নৈতিকতা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে অভিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসা বেশ কয়েকটি এনজিও৷
১৫ নভেম্বর এই চুক্তিটির সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাগুলো৷ এই চুক্তির অধীনে কোনো সহযোগিতা না দিতেও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে এনজিওগুলো৷
বিবৃতিতে সই করেছে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস, ইমার্জেন্সি, সি-ওয়াচ, এসওএস মেডিটেরানিসহ আরো বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা৷
অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং মানবপাচারকারী চক্রগুলো ভেঙে দেয়ার লক্ষ্যে এই চুক্তিটি সফল করতে চান ইটালির অতি-ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷ চুক্তি অনুযায়ী, এই প্রকল্প আগামী পাঁচ বছরের জন্য কার্যকর থাকবে৷ এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৭ কোটি ইউরো৷ ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা অভিবাসীদের আলবেনিয়ায় আনার পর দেশটির শেনজিন বন্দরের কেন্দ্রটিতে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করা হবে৷
পরে তাদের নেয়া হবে গজদারের তিনটি ভিন্ন অবকাঠামোতে৷ তিনটি অবকাঠামোর একটিতে রাখা হবে ‘ডিপোর্ট’ এর সিদ্ধান্ত পাওয়া অভিবাসীদের, দ্বিতীয়টিতে রাখা হবে আশ্রয়প্রার্থীদের এবং তৃতীয়টিতে রাখা হবে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা অভিযুক্ত অভিবাসীদের৷
যাদের আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর করা হবে তাদের আলবেনিয়া থেকে সরাসরি ইটালি নিয়ে যাওয়া হবে৷ আর যাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে তাদের আলবেনিয়া থেকেই ডিপোর্ট করা হবে বা নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে৷
কিন্তু চুক্তিটি বাস্তবায়নের বাধার মুখে পড়ছে মেলোনি প্রশাসন৷ এ নিয়ে অভিবাসীদের দুটি দলকে আলেবনিয়া পাঠানো হলেও, আদালতের রায়ে তাদের ইটালি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে রোম৷
অভিবাসীদের আলবেনিয়ার নির্মিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে রাখার যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে লুক্সেমবুর্গের ইউরোপীয় বিচার আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন ইটালির বিচারকেরা৷
অভিবাসীদের প্রথমে ইটালি নৌবাহিনীর জাহাজে এবং তারপরে আলবেনিয়ান কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে বেসরকারি সংস্থাগুলো৷ কারণ, চুক্তি অনুযায়ী শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ কোনো পুরুষ অভিবাসীকে আলবেনিয়া রাখা যাবে না৷
এনজিওগুলো বলছে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে কোনো উপযুক্ত বা গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনা সেখানে নেই৷ তারা বলছে, বিপজ্জনক পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীদের যারা শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের আলবেনিয়ার আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা উচিত নয়৷
এসব অভিবাসীর পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারসহ অন্যান্য গুরুতর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া উচিত বলেও মনে করে এনজিওগুলো৷
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ইটালি-আলবেনিয়া চুক্তি চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত নৈতিকতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে অভিবাসীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে৷’’
জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম এবং দ্য নাইটস অব মাল্টা-এর ইটালিয়ান রেসকিউ করপসের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও সমালোচনা করেছে এনজিওগুলো৷ তারা দাবি করেছে, সংস্থা দুইটি এই প্রকল্পে যুক্ত হয়ে স্পষ্টত মানবাধিকার লঙ্ঘনে ‘সহযোগী’ হিসাবে কাজ করছে৷
দ্য নাইটস অব মাল্টা দাবিটি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ সংস্থাটি বলেছে, আলবেনিয়া নিয়ে যাওয়া অভিবাসীদের স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো চিকিৎসক এবং নার্সেরা যুক্ত নন৷
সংস্থাটি আরো বলেছে, তাদের মেডিকেল টিম ২০০৮ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীদের উদ্ধারে যুক্ত ইটালির জাহাজগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আসছে এবং সেটি অব্যাহত রয়েছে৷
নাইটস অব মাল্টা জানিয়েছে, ‘‘১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সমুদ্রে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য তারা কাজ করছেন এবং এজন্য তারা গর্বিত৷ এই কর্মসূচিটি বন্ধ করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই৷’’
এই বিষয়টি নিয়ে আইওএম-এর প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে ই-মেইল করা হলেও, প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি৷
ইটালি সরকার বলেছে, আলবেনিয়ায় নির্মিত কেন্দ্রগুলোতে অভিবাসীদের অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করা হবে৷ এই চুক্তিটিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে ‘আউট-অব-বক্স চিন্তা’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন৷ তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও ইটালি এই চুক্তির মধ্য দিয়ে একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করলো৷
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা চুক্তির প্রথম তিন মাস তদারকি করতে সম্মত হয়েছে এবং এজন্য তাদের একটি দল স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে অভিবাসীবাহী জাহাজে অবস্থান করেন৷
সূত্রঃ এপি
এম.কে
২০ নভেম্বর ২০২৪