6.4 C
London
December 23, 2024
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদের উত্থান রূপকথাকেও হার মানায়

আব্দুস শহীদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের সাতবারের এমপিসহ হন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। রাজনীতির ছোঁয়ায় তার উত্থান রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। এমপি হয়েই বাগিয়ে নেন হুইপ, প্যানেল স্পিকারের পদ। সর্বশেষ ছিলেন সাত মাসের কৃষিমন্ত্রী। নামের আগে উপাধ্যক্ষ ও সর্বশেষ যুক্ত ডক্টরেট এবং মুক্তিযোদ্ধা উপাধি নিয়ে জেলাজুড়ে রয়েছে নানা আলোচনা। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই নেতা বর্তমানে কারাগারে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৭৩ সালে কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে ১৯৯১ সালে প্রথম আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেন। সেই সময় দলের অনেক ত্যাগী ও দক্ষ নেতাকে পাশ কাটিয়ে ভাগিয়ে নেন দলীয় মনোনয়ন। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে হুইপ, ২০০৬ সালে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চিফ হুইপ ও প্যানেল স্পিকার এবং ২০২৪ সালে ৭ মাসের কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রী হওয়ার আগেই বিভিন্ন পদে বসে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন আব্দুস শহীদ। জেলা ও উপজেলার রাজনীতিতে শহীদ পরিবারের ছিল একক আধিপত্য। নিজের ক্ষমতা বাড়াতে তিন ভাই ও বড় মেয়েকে দলীয় বিভিন্ন পদে আসীন করেন। এ ছাড়া মৌলভীবাজারসহ নিজ উপজেলা কমলগঞ্জে তার ও পরিবারের সদস্যদের ইশারা ছাড়া বাস্তবায়িত হতো না সরকারি কোনো প্রকল্প। এমন অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে।

স্থানীয়রা জানান, আব্দুস শহীদের ছোট ভাই মোসাদ্দেক আহমদ মানিক লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির পদ দীর্ঘদিন দখলে রাখেন। আরেক ভাই ইমতিয়াজ আহমদ বুলবুলকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক রফিকুর রহমানের বিপরীতে বিদ্রোহী দাঁড় করিয়ে বিজয়ী করেন। অন্য ভাই ইফতেখার আহমেদ বদরুল একাধিকবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতার দাপটে। বড় মেয়ে উম্মে ফারজানা ডায়নাকে পদ দেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদকের। উদ্দেশ্য ছিল আগামী সংসদ নির্বাচনে তাকে প্রার্থী করার। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মাঝে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আব্দুস শহীদ জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বে থাকাকালে জেলাজুড়ে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছিল চরমে। প্রয়াত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ও প্রয়াত সমাজ কল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। সেই সময় দলের একটি বড় অংশকে কোণঠাসা করে রাখেন তিনি। শুধু জেলা শহরেই নয়, আব্দুস শহীদ নিজের স্বার্থে কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ও দ্বন্দ্ব তৈরি করে রাখেন। নেতা-কর্মী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চা-বাগান প্রতিষ্ঠার নামে বন বিভাগের জমি দখল, বাগানবাড়ি নির্মাণ, হাইল-হাওরে মৎস্য খামারসহ নানাভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন আব্দুস শহীদ। ২০১৮ সালে কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে চার একর জমিতে ‘সাবারি টি প্ল্যান্টেশন’ করেন তিনি। পরে পাশে উদ্যানের ৫ একর পাহাড়ি জমি দখল করেন। সরকারি খরচে পুরো বাগানে পল্লী বিদ্যুতের লাইন টেনে পানি সেচে ১৩-১৪টি ডিপ টিউবওয়েল বসান। এ ছাড়া কমলগঞ্জের কাঁঠালকান্দিতে ৮ একর পাহাড়ি জমিতে গড়ে তোলেন বাগানবাড়ি ‘সাবারি ফার্মহাউস’। সরকারি খরচে এখানেও একাধিক ডিপ টিউবওয়েল এবং বিদ্যুতের জন্য কয়েকটি সৌরপ্ল্যান্ট বসান। হাইল-হাওর ও বাইক্কা বিলের পাশে প্রায় ২৭ বিঘা জমিতে করেছেন মৎস্য খামার। স্থানীয়রা এসব সম্পদ উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমলগঞ্জের এক মুক্তিযোদ্ধা জানান, ১৯৯৬ সালের আগে আব্দুস শহীদ কখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা শব্দ ব্যবহার করেননি। কিন্তু ওই বছর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধা ব্যবহার শুরু করেন। পরে জামুকার সদস্যও হয়েছেন। শুধু তাই নয়, প্রভাব খাটিয়ে ভাই মোসাদ্দেক আহমদ মানিককে ২০২১ সালে ‘মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি আদায় করে দেন।

এই বিষয়ে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান গত বছর (আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালীন) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এখন অনেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন, যুদ্ধের সময় তাদের দেখিনি, এমনকি যাদের বয়স যুদ্ধের সময় ৫-৬ বছর ছিল, এখন নাকি তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, এখন এগুলো নিয়ে আর কথা বলি না, অনেক নিকটাত্মীয় পরামর্শ দিয়েছেন এগুলো নিয়ে কথা না বলতে।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখলে থাকা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ৫ একর জমি উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। এ জমিতে বন্য প্রাণীর খাবার উপযোগী প্রায় পাঁচ হাজার ফলের চারা রোপণ করা হয়েছে।

বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান জানান, আগে বন বিভাগের পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা চালিয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখল থেকে জমি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গত ১৫ সেপ্টেম্বর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাঁচ একর জমি জবরদখল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মৌলভীবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক জহর লাল দত্ত বলেন, শুধু আব্দুস শহীদই না, সারা দেশে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবাধে লুটপাট করেছেন। নজিরবিহীন এ লুটপাটের বিচার করতে হবে।

বামফ্রন্ট নেতা বিশ্বজিৎ পাল বলেন, বিগত অবৈধ সরকারের আমলে সাধারণ মানুষ মুখ খুলে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। সাবেক এ মন্ত্রী কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে উপজেলা পর্যায়ে লুটপাটের বাহিনী তৈরি করেছিলেন। তদন্ত করলে তা বেরিয়ে আসবে। আমরা সব লুটপাটের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা বিএনপি সভাপতি নুরুল আলম সিদ্দিকী বলেন, সাবেক কৃষিমন্ত্রী দীর্ঘ ১৬ বছর এলাকায় বিএনপিকে কোনো মিটিং ও মিছিল করতে দেয়নি। শুধু বিএনপি নেতা-কর্মীই নন, সাধারণ মানুষও তার কাছ থেকে নিরাপদ ছিলেন না।

গত ২৯ অক্টোবর একাধিক হত্যা মামলায় ঢাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন আব্দুস শহীদ। এ সময় তার বাসায় পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি মুদ্রায় কয়েক কোটি টাকা ও স্বর্ণালংকার। এমন খবরে জেলাজুড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদকে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তার গ্রেপ্তারের খবরে নিজ নির্বাচনি এলাকার মানুষ আনন্দ মিছিল করেন। এ সময় অবৈধভাবে উপার্জিত তার সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।

সূত্রঃ খবরেরকাগজ

এম.কে
১৩ নভেম্বর ২০২৪

আরো পড়ুন

শাহ আবদুল করিমের মৃত্যু দিবসে টিভিথ্রিতে গান গাইলেন তার একমাত্র ছেলে

অনলাইন ডেস্ক

যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছেন শেখ হাসিনা

আমিরাতে সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন ৫০ হাজার বাংলাদেশি