11 C
London
March 3, 2025
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

একই সংবেদনশীলতা থাকলে উপদেষ্টার পদ থেকে ফারুকীরও পদত্যাগ করা উচিতঃ সৈয়দ জামিল আহমেদ

বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য ও সংগীত বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদ থেকে গত শুক্রবার তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের নেপথ্যের কারণ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে।

প্রথম আলো: আপনার আকস্মিক পদত্যাগের কারণ কী?

সৈয়দ জামিল আহমেদ: যেকোনো পদত্যাগই এক অর্থে আকস্মিক। বাংলাদেশে পদত্যাগের সংস্কৃতি নেই বলেই আমার পদত্যাগকে আকস্মিক বলে মনে হচ্ছে। এ দেশে এমন সবকিছু অহরহ ঘটছে, যখন আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে কিংবা নিজের পদের দায়িত্বের অর্থ অনুধাবন করে পদত্যাগের সংস্কৃতি তৈরি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমি নিজে যে অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধ থেকে শিল্পকলার মহাপরিচালকের পদ গ্রহণ করেছিলাম, তা বেশ কিছুদিন ধরেই পালন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলাম। কয়েক দিন ধরেই আমি ভাবছিলাম আমার জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট করণীয় কী? আমি কাজের প্রতিকূল পরিবেশ বিবেচনায় আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এক অর্থবছরের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নতুন অর্থবছরের জন্য এপিএ (বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি) তৈরি করে জুলাই মাসে আমার দায়িত্ব হস্তান্তর করব। এ বিষয়ে আমি পরিচালকদেরও অবগত করেছি।
কিন্তু উপদেষ্টার সঙ্গে ‘টক্সিক রিলেশন’ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের ঘটনা—সব মিলিয়ে আমাকে পদত্যাগেরই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে মূল্যবান। সারা জীবন আমি প্রতিটি সেকেন্ডকে মূল্য দিয়ে কাজ করে এসেছি। আমি যে সংবেদনশীলতা নিয়ে পদত্যাগ করেছি, এ মুহূর্তে একই সংবেদনশীলতা থাকলে উপদেষ্টার পদ থেকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীরও পদত্যাগ করা উচিত।
এখানে মনে হতে পারে আমি আরেকজনকে ইঙ্গিত করে কথা বলছি। আমার পদত্যাগের কারণ হলো সেই রাজনৈতিক নীতিবোধ, যার অর্থ হলো, ক্ষমতা যদি জনকল্যাণে চর্চা না করা যায়, তা দুটি ফলাফল তৈরি করে। এক হলো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখে মানব থেকে দানব হয়ে ওঠা। নতুবা ক্ষমতার চেয়ারে আসীন থাকতে আত্মমর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে দাসে পরিণত হওয়া। আর এতে সেই প্রতিষ্ঠানের ও জনগণের কোনো উপকারই হয় না।
আমার পদত্যাগের কারণ আমি বিস্তারিত বলেছি। এর সঙ্গে যুক্ত করে বলা যায়, যে পদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে প্রয়োগ করতে বাধার মুখে পড়তে হয়, সেই পদ ত্যাগ করাই ভালো।

প্রথম আলো: আপনি যে সমস্যাগুলোর কথা বললেন, তা কি অন্য কোনোভাবে সমাধান করা যেত না?

জামিল আহমেদ: অন্য কোনোভাবে সমাধান করা যেত। সেই ‘অন্য কোনো’ সমাধান হচ্ছে অযাচিত ও বিধিবহির্ভূত কর্তৃত্বের সঙ্গে আপস করা। দুর্নীতি ও অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য করার সুযোগ করে দেওয়া। শিল্পকলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসন ও জনগণের সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানোর নানা কর্মসূচিকে ভেতরে-বাইরের চক্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া। সেই অন্য সমাধান কি আপনারা আশা করেন আমার কাছে?

প্রথম আলো: সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা তার ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘অনেকগুলা কথা পুরো সত্য নয়, অনেকগুলা কথা ডাহা মিথ্যা এবং কিছু কথা পরিস্থিতি ডিল না করতে পারাজনিত হতাশা থেকে বের হয়ে আসা’—এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

জামিল আহমেদ: সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষক হিসেবে এ দেশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রায় ৫০ বছর ধরে কাজ করছি। আমাকে এসে কেউ বলুক যে আমি একজন মিথ্যাবাদী? আমি ঘোরপ্যাঁচের লোক নই। পেছনেও কথা বলি না। আমি চোখে চোখ রেখে সামনাসামনি কথা বলতে শিখেছি। তা-ই চর্চা করি। সংস্কৃতি উপদেষ্টা আমার বক্তব্যের জেরে যা বলেছেন, হয় তিনি তা অনুধাবন করতে পরেননি, কিংবা সেটা বুঝতে পেরে নিজের দায় এড়ানোর জন্য সত্য-মিথ্যার সংজ্ঞা জাহির করেছেন। আমি যা বলেছি তাতে একবিন্দুও মিথ্যা নেই। এর সবটুকুই সত্য।পরিস্থিতি আমি ডিল করতে পারিনি বলে হতাশ হয়েছি, এই যদি হয় তার বক্তব্য, তাহলে তিনি পরিস্থিতিও বোঝেননি, হতাশাও চিনতে পারেননি। আর ‘ডিল করা’ বলতে যা বোঝায়, তা-ও তিনি বোঝেননি। বরং সংস্কৃতি উপদেষ্টাই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি। বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি তার বড় প্রমাণ। তিনি উপদেষ্টার পদে থেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গৌরবময় ওই প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে কারও কারও পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। এসব সবারই স্মরণে রয়েছে। এক কঠিন দুঃসময়ে, একটা স্তব্ধতার মধ্যে আমি দায়িত্ব নিয়ে সারা দেশে বহুমুখী সাংস্কৃতিক চর্চায় উৎসবের সূচনা ঘটিয়েছি। এ পর্যন্ত ৩২টি জেলায় গিয়েছি। শিল্পকলা একাডেমি এবং স্থানীয় শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মী ও মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে উজ্জীবিত করেছি। সংলাপের সূচনা ঘটিয়ে প্লুরালিস্টিক ডেমোক্রেটিক কালচারাল জোয়ার বইতে শুরু করেছে। সেই কঠিন সময়কে আমি জয় করে কাজ করেছি। যখন সবাই বলছে ডানপন্থা, উগ্রবাদ বাংলাদেশ দখল করে নিয়েছে, শিল্পকলা একাডেমির দেশব্যাপী বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রমাণ করেছে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক প্লাবন এসেছে।

প্রথম আলো: শিল্পকলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসন নিয়ে কিছু বলবেন? আপনি কি নিজের মতো করে কাজ করতে পেরেছেন?

জামিল আহমেদ: ব্যক্তিগতভাবে এই পদে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। আমাকে যখন প্রস্তাব দেওয়া হয় তখন বলেছি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ দিতে হবে। কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। তাঁরা রাজি ছিলেন। আমি বিধি মেনে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়েছি। আমার নাটকের দল ছেড়েছি। বিস্তারিত কর্মসূচি দিয়েছি। পরে উপদেষ্টা যখন পরিবর্তন হলো তখন থেকেই তিনি নানাভাবে কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য একদিন আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিন ঘণ্টা বৈঠক করে বলেছি সারা বছর কী করতে চাই। বলেছি, অন্তত ২০ জেলায় শিল্পকলা একাডেমিতে হামলা হয়েছে। ১২টি মিলনায়তন সম্পূর্ণ নতুন করে করতে হবে। এ জন্য অর্থছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছি। জনগণের টাকা জনগণের জন্য খরচ করতে হবে। আমি ব্যক্তিগত কিছু নিচ্ছি না। কিন্তু উপদেষ্টা নানাভাবে আমার কাজে হস্তক্ষেপ করেন। মহাপরিচালককে অগ্রাহ্য করে একাডেমির সচিবকে ‘ফোকাল পয়েন্ট’ করা হয়েছে। তার মাধ্যমে মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ-নির্দেশ দেওয়া হয়। এভাবে একাডেমির কার্যক্রম মন্থর করে দেওয়া হয়েছে।অনেক রকমের অন্যায়-দুর্নীতিতে প্রতিষ্ঠানটি ছেয়ে গেছে। সেগুলো দূর করার চেষ্টা করেছি। একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সম্মানী নেন। তারা বেতনও পান। এটা বন্ধ করেছি। শিল্পীরা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে নাচ-গান করতেন। একাডেমি থেকে সে জন্য বিল নিতেন। নির্দেশ দিয়েছি, সরকারি অনুষ্ঠান ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রী বা কারও বাড়িতে বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা বন্ধ। আর খরচের হিসাব ওয়েবসাইটে দিতে হবে। এসব নিয়ে সুবিধাভোগীরা অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। এই দুষ্টচক্র টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদের মাধ্যমে একাডেমিতে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। অফিসের ফাইল চুরি করা হয়েছে। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। উপদেষ্টা একটি ভিডিও চিত্র তৈরির জন্য নির্মাতাকে অর্থ দিতে বলেন আমাকে। আমি কিছুই জানি না কিসের ভিডিও, কবে করা হয়েছে। আমি বলেছি, এভাবে টাকা দেওয়া যায় না। টাকা দিতে হলে আমাকে লিখিত জানাতে হবে। এ নিয়ে টেলিফোনে উপদেষ্টার সঙ্গে আমার বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছে। আমি চিঠি না পেলে টাকা দিতে পারব না, সিদ্ধান্তে অনড় থাকি। পরে তিনি চিঠি দেন।

প্রথম আলো: পদত্যাগের জন্য আপনাকে কি চাপ দেওয়া হচ্ছিল?

জামিল আহমেদ: অনেকবার বলেছি, আমি যদি কাজ করতে না পারি পদ আঁকড়ে থাকব না। মাথা নত করে থাকব না। আমাকে বহিষ্কার করেন। তারা সেটি করেনি। কিন্তু পরিস্থিতিটি এমন তৈরি হয়েছিল যে স্বাধীন কাজ করা যাচ্ছিল না। সম্মানের সঙ্গে, মাথা তুলে থাকা যাচ্ছিল না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

জামিল আহমেদ: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।

সূত্রঃ প্রথম আলো
০৩ মার্চ ২০২৫

আরো পড়ুন

ভোটার হতে গিয়ে পাগলের তালিকায়

বন্যাদুর্গত বাংলাদেশিদের নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার এ কেমন হাস্যরস!

রংপুর রণক্ষেত্র, সিটি কাউন্সিলরসহ নিহত ৪