
ফিচার: কুয়াংচোওতে আমি গিয়েছিলাম ব্যবসায়িক কাজে। তবে, ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলেও এমন একটি প্রাচীন শহরের কোনো স্থাপনা না দেখে ফিরে আসা অপরাধ। তাই এক বিকেলে গেলাম হুইশাং মসজিদ দেখতে।
এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি মসজিদ। ৬২৭ সালে নির্মিত এ মসজিদটি মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এর এক আত্মীয় ( চাচা অথবা মামা) গড়ে তোলেন। ইসলাম শুরুর আগে থেকেই এই বন্দর নগরীতে আরব বণিকদের এক সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্যই এই মসজিদ গড়ে তোলা হয়।
মসজিদটির মূল ভবন ও মিনার এখনও ব্যবহার করা হয়। প্রাচীন মাটির দেয়ালের নমুনাও সংরক্ষিত আছে। এখানে সেই সময়কার একটি কুয়া থেকে এখনও ওযুর পানি সরবরাহ করা হয়। শরতের বিকেলে সেই প্রাচীন মসজিদে নামাজ পড়তে দারুণ এক অনুভুতি হয়েছিল।
এই মসজিদকে ঘিরে এই এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমের বসবাস রয়েছে। চীন সরকারের পক্ষ থেকে মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর বর্ধিতকরণের খরচ দেওয়া হয়। আমি এইসব এলাকায় যে ঘুরে বেড়িয়েছি সেটা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। তাই প্রকৃত চিত্রটা দেখেছি এতে কোন সন্দেহ নেই। আমি সেখানে মুসলিমদের খুব ভালোভাবে, স্বাধীনভাবে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করতে দেখেছি। নামাজ পড়তে দেখেছি। কেউ তাদের ধর্ম পালনে বাধা দিচ্ছে না। সেখানে মহল্লার ভিতরে শিশু ও বৃদ্ধদের নিশ্চিন্তমনে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কোন রকম পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেখিনি।

এবার বলি উরুমছির অভিজ্ঞতা।
২০১৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ১১ দিনের একটি কর্মসূচিতে চতুর্থবারের মতো চীনে যাওয়ার সুযোগ হয়। চীন সরকার তাদের মিডিয়া ট্যুর কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের ১২জন সাংবাদিককে চীন সফরে নিয়ে যান। সেই সফরে আমরা চারটি প্রদেশের পাঁচটি শহরে ভ্রমণ করি। এই শহরগুলোর মধ্যে উরুমছিতে তিনদিন থাকা হয়।
শিনচিয়াং হলো চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত উইঘুর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। বিশাল একটি অঞ্চল। ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এলাকা।এই অঞ্চলের রাজধানী উরুমছি।
চীনে যে ২.৩ কোটি মুসলিম রয়েছেন তাদের প্রায় অর্ধেকই বাস করেন এই প্রদেশে।এই অঞ্চলের দশটি জাতির মানুষ মুসলিম। আর চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতির মানুষ তো আছেই। এখানকার মুসলিমদের উন্নয়নের জন্য চীনের বর্তমান সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। মসজিদের ইমামের সঙ্গে এবং মুসলিম কমিউনিটির অন্যদের সঙ্গেও কথা বললাম। তারা খুব সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন বর্তমান চীন সরকারের প্রতি।এখানে গ্র্যান্ড বাজার বা মসজিদ বাজার নামে একটি বড় জায়গা রয়েছে। সেখানে মসজিদের বিশাল মিনারের স্থাপত্য শৈলী অনবদ্য। এখানে শপিং করারও সুযোগ পেলাম। বিরাট শপিং কমপ্লেক্স। মধ্যএশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক থেকে শুরু করে স্যুভেনির আর খাবার দাবারের ছড়াছড়ি। এখানে আশপাশে সকলেই মুসলিম। মসজিদে আজানও পড়লো। দেখলাম দলে দলে মুসলিম যাচ্ছেন মসজিদে নামাজ পড়তে।
উরুমছি শহরে বিভিন্ন জাতির মুসলিম নারী ও পুরুষরা স্বাধীনভাবে বেছে নিচ্ছেন বিভিন্ন পেশা। ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন অনেকেই। রেস্টুরেন্ট, পোশাকের দোকানসহ বিভিন্ন রকম ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা। চীনের অন্যান্য শহরের মতো এখানেও পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ব্যস্ত পদচারণা চোখে পড়ে। রাস্তাঘাটে বড় বড় গাড়ি সাবলীলভাবে চালাচ্ছেন নারীরা। যে প্রতিষ্ঠানেই যাই না কেন, চোখে পড়ছে নারীর স্বতস্ফূর্ত ও সম অংশগ্রহণ। শুধু সম অংশগ্রহণ নয় বরং বলা যায় নারীরা যেন পুরুষের চেয়েও বেশি কর্মদক্ষ। এই প্রদেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান শিনচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রশাসনিক প্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগেও প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন নারী। এখানে মুসলিম জনগোষ্ঠি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। মুসলিম ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করছে।

উরুমছি শহরে ছোটবড় অনেক মসজিদ রয়েছে। রয়েছে হুইজাতির ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য একটি বিশেষ এলাকা। সেখানে মুসলিম ধর্মাবলম্বী হুইজাতির মানুষরা সুভ্যেনির শপ এবং অনেকগুলো বিশাল রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন। সেখানে তাদের বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে।
বর্তমানে আমি কুনমিং শহরে রয়েছি। কুনমিং শহরে রয়েছে ছোট বড় বেশ কয়েকটি মসজিদ। শহরের প্রাণকেন্দ্র নানপিং চিয়েতে রয়েছে বহুতল একটি মসজিদ। এটি কেন্দ্রীয় মসজিদ। বিশাল বড়। এখানে ঈদের জামাত হয়। এর কাছেই মুসলিম কমিউনিটি রয়েছে। সেখানে রয়েছে বড় একটি বাজার। সকালে খোলা বাজারও বসে। হালাল মাংসসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিক্রি হয়।
শহরের অন্যান্য এলাকাতেও রয়েছে হালাল খাবারের রেস্টুরেন্ট। হালাল মাংসের দোকান। বাজারেও রয়েছে হালাল মাংসের আলাদা দোকান। কুনমিং শহরে পথচলতি প্রচুর মুসলিম চোখে পড়ে। মেয়েরা অনেকেই মাথায় হিজাব পরেন, ছেলেরা টুপি। আবার হিজাব ছাড়াও অনেক মুসলিম নারী চলাফেরা করেন।
চীনের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ক্যান্টিন আছে। সেখানে হালাল খাবার পরিবেশিত হয়। প্রতিটি বড় শহরে মসজিদ আছে। মুসলামানদের ধর্ম পালনে কেউ বাধা দেয় না। আমি চীনের অনেক মুসলিম গ্রামে গিয়েছি। কাউকে দেখেই মনে হয়নি তারা অসুখী বা খুব দুঃখে আছে বা নির্যাতনের ভিতর আছে। তাদের বাড়িঘরও যথেষ্ট উন্নত।
আমার ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের মধ্যেও অনেকে মুসলিম আছেন। তারাও স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম পালন করছেন।
হাজার বছর ধরেই চীনে মুসলিম জনগোষ্ঠি বাস করছে। তারা চীনের ঐতিহ্য, নিজেদের জাতিগত সংস্কৃতি এবং ইসলাম ধর্ম পালন করে সুখে আছেন, শান্তিতে আছেন।
(প্রথম প্রকাশিত চায়না মিডিয়া গ্রুপের ওয়েবসাইটে)

২৭ আগস্ট ২০২০
এনএইচটি