আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বর্তমানে তার দ্বিতীয় দফা রিমান্ড চলছে। গত ১১ বছর ধরে পররাষ্ট্র, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ মন্ত্রী। যদিও সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে। অভিযোগ রয়েছে, তার সময়েই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির জাল ছড়িয়েছে উচ্চশিক্ষা খাতের প্রায় সব স্তরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু দুর্নীতি নিয়ে নয়; সমালোচিত হয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানের সঙ্গে থাকা ‘গভীর সখ্যতা’ নিয়েও। শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অনেকটাই ছায়া মন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন অধ্যাপক মশিউর; যা নিয়ে তৎকালীন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, অধ্যাপক মশিউর ও ডা. দীপু মনির ত্রি-মুখী স্নায়ুযুদ্ধ ছিল ওপেন সিক্রেট। বিষয়টি শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি আরও গুটিকয়েক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অফিসিয়াল কার্যাবলীর বাইরে দু’জনের আলাদা সময় কাটানো, বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন কিংবা শিক্ষাখাতের বাইরে যেকোনো অনুষ্ঠানে হরহামেশা একসঙ্গে অতিথি হওয়া কিংবা বিনা নোটিশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা অফিসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল ডা. দীপু মনির নিয়মিত রুটিনের একটি। যদিও মন্ত্রীর প্রটোকল অনুযায়ী, তিনি কোথাও গেলে আগে থেকে নোটিশ করার নিয়ম রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর অধিকাংশ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মশিউরের অপ্রাসঙ্গিক উপস্থিতি বা অতিথি হওয়া ছিল দৃষ্টিকটূ। শেষের দিকে তো দীপু মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মশিউর অতিথি হওয়া যেন রীতি হয়ে উঠেছিল।
২০১৮ সালে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০১৯ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ডা. দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মশিউর রহমানকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের বন্দোবস্ত করেন তিনি। মূলত এরপর থেকেই ছায়া শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন অধ্যাপক মশিউর।
অভিযোগ রয়েছে, তুলনামূলক জুনিয়র ও প্রশাসনিকভাবে অনভিজ্ঞ হলেও ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে অধ্যাপক মশিউরকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য থেকে সরাসরি উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন ডা. দীপু মনি। শিক্ষা নিয়ে ওই অর্থে গবেষণা না থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত প্রায় সব অনুষ্ঠানেই অধ্যাপক মশিউর ছিলেন নিয়মতি অতিথি। বিপরীতে শিক্ষা-গবেষণায় অভিজ্ঞ অধ্যাপক এমনকি অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের ওইসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার দাওয়াতও মিলত না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর অধিকাংশ অনুষ্ঠানে মশিউরের অপ্রাসঙ্গিক উপস্থিতি বা অতিথি হওয়া ছিল দৃষ্টিকটূ। শেষের দিকে তো দীপু মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে মশিউর অতিথি হওয়া যেন রীতি হয়ে উঠেছিল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মশিউর নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলোতেও ডা. দীপু মনির সরব উপস্থিতি ছিল সবসময় চোখে পড়ার মত। সেসব অনুষ্ঠানের অধিকাংশই আয়োজন করা হত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ছাড়াও ধানমন্ডিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক অফিসে বসে শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কে হবেন, কাকে কোথায় বদলি করতে হবে— মাঝে মাঝে এমন সিদ্ধান্ত আসত এ দুটি অফিস থেকে। এসব কাজে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদের অভিযোগও রয়েছে।
অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য হওয়ার দরুন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়েছিল। এটিকে যদি কেউ সম্পর্কে রূপ দিতে চায়, তাহলে বিষয়টি ভিন্ন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের পরিচালক মর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গেও নানা বিবাদে জড়িয়েছেন অধ্যাপক মশিউর। ইউজিসির বাধা সত্ত্বেও শিক্ষামন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে বাজেট বৃদ্ধি, অন-ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নানা কার্য সম্পাদন করেছেন তিনি। যদিও এসবের কোনো কিছুই স্বীকার করেননি অধ্যাপক মশিউর। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউজিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অন-ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে নিষেধ করেছিল ইউজিসি। তবে সেই নিষেধাজ্ঞার থোরাই কেয়ার করেছেন অধ্যাপক মশিউর। ডা. দীপু মনির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় আমাদের নির্দেশনা না মেনে তিনি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছিলেন। প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার ভেতর ফেলে দিয়েছিলেন তিনি।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, করোনকালীন সময়ে ব্লেন্ডেড এডুকেশন নিয়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানে ডিনারের আগে অতিথিদের বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখানোর উদ্যোগ নেয় ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষ। সে সময় দীপু মনি এবং অধ্যাপক মশিউর রহমানের পাশাপাশি হাঁটার বিষয়টি ছিল সবার কাছে দৃষ্টিকটু। এ ঘটনায় অনেকে বিব্রতও হয়েছিলেন। তবে রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউ তখন মুখ খোলেননি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক এক কর্মকর্তা বলেন, সেদিন দীপু মনি এবং মশিউর রহমানের ঘনিষ্ঠভাবে হাঁটা তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি।শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন অফিসিয়াল কাজে ডা. দীপু মনির বিদেশ ভ্রমণে প্রায় নিয়মতি সফরসঙ্গী ছিলেন অধ্যাপক মশিউর; যেখানে অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের খুব কমই দেখা গেছে।
অধ্যাপক মশিউর রহমান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধানমন্ডির আঞ্চলিক অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করতেন দীপু মনি। প্রোটোকল ভেঙে কোনো নোটিশ ছাড়াই এখানে যাতায়াত ছিল ডা. দীপু মনির।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, ব্লেন্ডেড লার্নিং এডুকেশন প্রোগ্রামের সবচেয়ে বড় অংশীদার ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অনুষ্ঠানে ডিনারের আগে আমাদের ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিল। সে সময় প্রায় শতাধিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রীর বডি গার্ডসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা ছিলেন। তাছাড়া আমি আর কিছু বলতে পারবো না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রো-ভিসি (উপ-উপাচার্য) হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। ওই দিন রাতে একই দপ্তরের আরেক প্রজ্ঞাপনে এই নিয়োগ স্থগিত করা হয়। তবে প্রজ্ঞাপন স্থগিত করার কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নিয়োগ দুপুরে, রাতে স্থগিতের এমন ঘটনা শিক্ষা প্রশাসনের নজিরবিহীন। ফলে এ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় সংশ্লিষ্ট মহলে। যদিও ওই প্রজ্ঞাপন স্থগিতের নেপথ্যে ডা. দীপু মনি ও অধ্যাপক মশিউরের সখ্যতাকে প্রধানত দায়ী করেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রীর সঙ্গেও স্নায়ুযুদ্ধে জড়ান ডা. দীপু মনি; যার রেশ দীর্ঘদিন থেকে যায়।
জানা যায়, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে নিয়োগ-স্থগিতে কলকাঠি নাড়েন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওই শীর্ষ কর্তা; ড. মিজান যোগদান করলে সেই শীর্ষ ব্যক্তি পদত্যাগের এমনকি দেখে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বিশেষ একটি অঞ্চলের আধিপত্য-প্রাধান্য। নতুন প্রো-ভিসি ড. মিজান সেখানে যোগদান করলে তাদের সেই আধিপত্য-প্রাধান্য কমে যাওয়ার শঙ্কা ছিল বলেই ডা. দীপু মনিকে কাজে লাগিয়ে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেন অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান- এমনটাই অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
সূত্রঃ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস
এম.কে
২৮ আগস্ট ২০২৪