স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ছোট্ট জনাকীর্ণ এক ওয়ার্ডে শুয়ে আছেন প্রসূতি মা ও অন্য গর্ভবতী নারীরা। মাথার ওপর সশব্দে ঘুরছে বহু পুরোনো ফ্যান। এক ঘরেই ২০ জনের বেশি নারী রয়েছেন গাদাগাদি করে। মাঝে নেই কোনো পর্দা। খুলনার দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে গেলেই এমন চিত্র চোখে পড়বে।
ওয়ার্ডের এক শয্যায় আছেন ২৩ বছর বয়সী সুপ্রিয়া রায়। তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম গর্ভাবস্থায় বেশ জটিলতা ছিল। সময়ের দুই মাস আগেই সন্তান প্রসব করতে হয়েছিল। তাই আমি এবারের সন্তান নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমার উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়েছে, ডাক্তার প্রস্রাবে প্রোটিন পেয়েছেন। তাই এবার আমাকে বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমার কৃত্রিমভাবে প্রসব বেদনা শুরু করার ব্যবস্থা করতে হতে পারে বা সিজার করতে হতে পারে।’
সুপ্রিয়ার প্রি-এক্লাম্পসিয়া বা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা রয়েছে। সাধারণত গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ থেকে বা সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপরই কিছু নারীর মধ্যে এ ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। আক্রান্ত নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। সাধারণত গর্ভাবস্থার ৩৭ বা ৩৮ সপ্তাহ থেকেই এই পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও আগে থেকেও শুরু হতে পারে।
তবে সুপ্রিয়া একা নন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা দাকোপে আশঙ্কাজনক হারে গর্ভবতী নারীদের প্রি-এক্লাম্পসিয়া, এক্লাম্পসিয়া ও উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, খাওয়ার পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে এ ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
পরিবেশগত মহামারিবিদ্যার গবেষক আনির খান বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। এটি গর্ভবতী নারীদের বিশেষ করে প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকিতে ফেলে। এতে নারীর গুরুতর মাথাব্যথা, অঙ্গহানি এবং এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।’
২০০৮ সালে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং খাবার পানির উৎস থেকে লবণ গ্রহণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন আনির খান।
২০১১ সালে লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের সঙ্গে দ্বিতীয় গবেষণা পরিচালনা করেন খান। এ গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, দাকোপের নারীদের মধ্যে লবণ গ্রহণের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নিরাপদ মানের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিবেদনটি লবণ গ্রহণ এবং প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টির ঝুঁকির মধ্যে বেশ দৃঢ় সম্পর্ক নিশ্চিত করেছে।
দাকোপ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু সংকটের প্রভাবের সামনের সারিতে রয়েছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী রান্না, খাওয়ার পানি এবং গোসলের জন্য নদী, পুকুর এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে এই প্রাকৃতিক উৎসগুলো বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় দূষিত হচ্ছে।
হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সন্তোষ কুমার বলেন, ‘২০০৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে তখন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়, বাঁধ ভেঙে যায় ও পুরো এলাকা লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যায়। বেশির ভাগ মিঠাপানির অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলগুলো খাওয়ার পানির তীব্র সংকটে পড়েছে। তবে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাবের মাত্রা এখন মাত্র ধরা পড়া শুরু করেছে।’
আনির খানের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দাকোপের পানিতে লবণাক্ততা কমানোর জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে বিপরীত অভিস্রবণ (রিভার্স অসমোসিস), বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ভূগর্ভে পানি সংরক্ষণ। অ্যাকুইফার রিচার্জ বা ভূগর্ভে পানি সংরক্ষণ এমন একটি কৌশল যার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের পানি ভূগর্ভে পাঠিয়ে অ্যাকুইফারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, যা পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য উত্তোলন করা হয়। এটি প্রাকৃতিকভাবেও ঘটে। আবার দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় কৃত্রিম উপায়ে করা হয়।
এই নতুন পদক্ষেপগুলো কার্যকর কি না তা দেখতে ২০১৯ সালে আবার দাকোপে ফিরে যান আনির খান। গবেষণার জন্য প্রায় ৭৪০ নারীর সাক্ষাৎকার নেন খান। স্থানীয়দের মধ্যে এখনো উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখেন তিনি। তবে কোভিডের স্বাস্থ্যবিধির কারণে সমীক্ষা সম্পন্ন করতে পারেননি তিনি। খান এখন ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের সঙ্গে একটি নতুন গবেষণার পরিকল্পনা করছেন। এতে পদক্ষেপগুলো বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে কি না তা মূল্যায়ন করা হবে।
এদিকে দাকোপে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা করছেন ড. সন্তোষ কুমার। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ভবিষ্যতে এখানে লবণাক্ততার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এ অঞ্চলের সব নারী ও মেয়ে শিশুরা হুমকির মুখে আছে। নিরাপদ খাবার পানির অভাবে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটবে।’
প্রায় ২০ বছর ধরে স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ করছেন নির্মলা সরকার (৫৬)। প্রতিদিন তিনি দাকোপের বিভিন্ন গ্রামে সুপেয় পানি পান করার গুরুত্ব বোঝাতে দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ান। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত উচ্চ উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, এখানকার বেশির ভাগ মানুষ ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নয়।
দাকোপে প্রায় পাঁচ হাজার গর্ভবতী নারীকে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ ও সেবা দিয়েছেন নির্মলা সরকার। তিনি তাদের নিয়মিত চেকআপ করেন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত সেশন করে থাকেন। এ সেশনে নারীরা স্বাস্থ্যগত যেকোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
নির্মলা বলেন, ‘মূল সমস্যা হচ্ছে, সচেতনতার অভাব। গর্ভকালীন সঠিক যত্ন এবং নিরাপদ খাওয়ার পানি পানের অভ্যাস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ালে স্বাস্থ্যগত উন্নতি করা সম্ভব হবে, যা সরাসরি মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি করবে।’ সহজে গ্রামে বিতরণ করা যায় এমন তথ্য ও উপকরণ তৈরি করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনাগত শিশুর ওপরও প্রভাব ফেলে প্রি-এক্লাম্পসিয়া। আক্রান্ত মায়েদের গর্ভেই সন্তানের মৃত্যু ঘটার ঝুঁকি থাকে, সন্তান কম ওজনের হতে পারে বা ভ্রূণের বিকাশে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হতে পারে। জন্মের আগেই অপুষ্টিতে ভুগলে শিশুদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তৈরি হয় এবং তাদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয়।
দাকোপ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে একটি ব্যস্ত বাজারে ছোট ভ্যানে করে খালি ব্যারেল ও কনটেইনার নিয়ে বসে লোকেরা। বেশ কয়েকটি দোকানে গ্যালনে করে পরিষ্কার ও ফিল্টার করা পানি বিক্রি করা হয়।
এখানে অনেক পরিবারই ফিল্টার করা পানি বা বড় পানির ট্যাংকি কেনার জন্য ঋণ নিয়ে থাকেন। বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা যায়, তবে এর জন্য বাসা বাড়িতে বড় ট্যাংকির প্রয়োজন। দাকোপে বেশির ভাগ পরিবারের জন্য এটি সম্ভব নয়। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে খড়ের চালা। বাংলাদেশ সরকার ওই অঞ্চলের স্কুল ও অন্যান্য ভবনের ছাদে ট্যাংকি স্থাপন করেছে। কিন্তু মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে দূর-দূরান্তে যেতে হয় এবং লম্বা লাইন ধরে অপেক্ষা করতে হয়।
ড. সন্তোষ কুমার বলেন, ‘পরিষ্কার ও নিরাপদ সুপেয় পানি সবার মৌলিক অধিকার। কারোরই লবণাক্ত পানি পান করে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নেওয়া উচিত না।’ এরপরও বাংলাদেশ জলবায়ু বিপর্যয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়ায় দাকোপের পানি সংকট আরও বাড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে পারব না। তাই আমাদের অবশ্যই বিকল্প হিসেবে আরও টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
০৩ এপ্রিল ২০২৪