বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছেই না সিলেটের এমসি (মুরারিচাঁদ) কলেজের। সোয়াশ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ কলেজে একের পর এক বিতর্কিত ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হচ্ছে।
ছাত্রাবাসে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় চলার পাশাপাশি এবার এ কলেজের টিলা কাটার অভিযোগ উঠেছে। এর আগে ২০১২ সালে এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ ও ২০১৬ সালে ক্যাম্পাসের ভেতরে খাদিজা আক্তার নামে এক ছাত্রীকে কুপানোর ঘটনায় এমসি কলেজের নাম দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়।
সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া আট ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ঘটনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
এদিকে ক্যাম্পাস ফাঁকা থাকার সুযোগে এমসি কলেজের ভেতরে চলছে টিলা কাটা। খননযন্ত্র দিয়ে কাটা হচ্ছে ‘থ্যাকারের টিলা’ নামের একটি ঐতিহাসিক টিলা। যদিও সংশ্লিষ্টরা টিলা কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জানা যায়, এমসি কলেজের পুরনো ক্যান্টিনের জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে ১০ তলা একাডেমিক ভবন। ২০১৭ সালের আগস্টে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ভবনের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তবে উদ্বোধনের অনেক পর শুরু হয় নির্মাণকাজ। করোনার কারণেও গত কয়েক মাস কাজ বন্ধ ছিল। সম্প্রতি আবার কাজ শুরু হয়েছে।
প্রায় ১২৪ একরের বিশাল ক্যাম্পাসের উঁচু-নিচু টিলা, দীঘি, গাছের সারি আর আসাম প্যাটার্নের সেমিপাকা ভবনের জন্য পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় এ কলেজ ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের ভেতরে দীঘির পাড়ে নির্মিত হচ্ছে ১০ তলা ভবন। নির্মাণকাজের শুরুতেই উঁচু এ ভবনের কারণে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে তাদের শঙ্কা আমলে না নিয়ে শুরু হয় ভবন নির্মাণের কাজ। এ ভবন নির্মাণে ভেঙে ফেলা হয় পুরনো ছাত্রাবাস।
শনিবার এমসি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, ধর্ষণকাণ্ডের পর থেকে বন্ধ রয়েছে কলেজের মূল ফটক। ফটকে রয়েছে পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষী। কাউকে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজন থাকলে নিরাপত্তারক্ষীর খাতায় নাম নিবন্ধন করে ভেতরে প্রবেশ করতে হচ্ছে।
ক্যাম্পাসের ভেতরের দীঘির পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নতুন ভবনের পাইলিং কাজ শেষ করে লিন্টার টানা হচ্ছে। খননযন্ত্র দিয়ে পাশের টিলা থেকে মাটি কেটে ফেলা হচ্ছে নির্মাণাধীন ভবনের জায়গায়।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে টিলা কাটা হচ্ছে সেটি ‘থ্যাকারের টিলা’ নামে পরিচিত একটি ঐতিহাসিক টিলা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেটের প্রথম কালেক্টর উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারের বসবাসের জন্য ১৭৭২-৭৫ সালের দিকে এ টিলার ওপর বাংলো তৈরি করা হয়। ১৮৯২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র রায় তার পিতামহের নামে ‘মুরারিচাঁদ কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে এর ক্যাম্পাস ছিল শহরের বন্দরবাজার এলাকায়। পরে টিলাগড়ে থ্যাকারের টিলা এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। টিলার ওপর থ্যাকারের বাংলোটি বর্তমানে এমসি কলেজ অধ্যক্ষের বাংলো হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। ঐতিহাসিক এ টিলারই ঢালু অংশ কাটা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সমিতি (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, এর আগে করোনার সময় বন্ধের সুযোগে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভবন নির্মাণের নামে টিলা কর্তন করা হয়। এবার এমসি কলেজেও একই কাণ্ড হচ্ছে। অথচ এমসি কলেজের বিশাল ক্যাম্পাসে ভবন নির্মাণের জন্য জায়গার অভাব ছিল না। তিনি বলেন, সিলেটে টিলা কাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কেউ তা মানছে না। প্রশাসনও এ ব্যাপারে নীরব।
শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের পাশেই আছেন ঠিকাদার হুমায়ুন কবির। তার উপস্থিতিতেই চলছে টিলা কাটা। এ ব্যাপারে হুমায়ুন কবির বলেন, আমাকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলেছেন, এটি টিলা নয়। পাইলিংয়ের সময় এ জায়গার মাটি নিয়ে পাশে রাখা হয়েছে। ফলে এ মাটি কেটে এনে আবার ভবনের জায়গায় ফেলে দিচ্ছি।
শনিবার এমসি কলেজের ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন শাহপরান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, টিলা কাটার অভিযোগ পেয়ে আমি মৌখিকভাবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি। বিষয়টি কলেজ অধ্যক্ষকে জানানো হয়েছে। তিনি এসে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।
এ ব্যাপারে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সালেহ আহমদ বলেন, যে জায়গার মাটি কাটা হচ্ছে, সেটি কোনো টিলা নয়। ভবন নির্মাণের আগে পাইলিংয়ের সময় নির্মাণস্থল থেকে মাটি খুঁড়ে পাশে রাখা হয়েছিল। সেই মাটিই কেটে আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ ছিল। এ কারণে ফেলে রাখা মাটিতে ঘাস উঠে গেছে। এ কারণে এখন টিলার মতো দেখাচ্ছে।
১৬ অক্টোবর ২০২০
এমকেসি / এনএইচ