১৯৯৬ সালের বসন্তের এক সকালে ২৭ বছর বয়সী এলি লোবেলে প্রকৃতি দর্শনে গিয়ে বিষাক্ত টিক পোকার দংশনের শিকার হলে তার শরীরে বোরেলিয়া বার্গডরফেরি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়। তিনি আক্রান্ত হন ‘লাইম ডিজিজে’। হুইলচেয়ারে বসে কাটিয়ে দেন ১৫টি বছর। তারপর ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা।
টিক পোকার দংশনে প্রতিবছর লাইম ডিজিজে আমেরিকায় প্রায় তিন লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। সময়মতো চিকিৎসা পেলে এটি নিরাময়যোগ্য। কিন্তু এলির ক্ষেত্রে রোগ ধরা পড়ে এক বছর পর। তত দিনে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তার স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপিণ্ড এবং অস্থিসন্ধিতে।
এলি নিজে ছিলেন একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ ও তিন সন্তানের মা। অথচ একসময় তাকে দেখা গেল বিছানায় পড়ে থাকা অচল, স্মৃতিহীন এক মানুষ হিসেবে। একের পর এক ভুল রোগনির্ণয় হয় তার। কখনো বলা হলো মাল্টিপল স্কেলেরোসিস, কখনো লুপাস, কখনো রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, কখনোবা ফাইব্রোলাইলজিয়া। ওষুধে সাময়িক আরাম মিললেও পুনঃসংক্রমণ হতো; প্রতিবারের সংক্রমণ আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ। ধীরে ধীরে ছেলেমেয়েরাও বড় হতে লাগল। তার পরিচর্যার জন্য সঙ্গে রাখা হলো একজন কেয়ারগিভারকে। ১৫ বছর লড়াইয়ের পর এলি ৪৫ বছর বয়সে এসে বলেন, ‘এটাই শেষ। আমি আর বাঁচতে চাই না।’
স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইউথেনেশিয়া করার ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। জীবনের শেষ সময় কাটাতে এলি পাড়ি দেন ক্যালিফোর্নিয়ার এক গ্রামে, যেখানে সবুজ প্রকৃতি আর শান্তি তাকে বিদায় জানাবে। এক সকালে হুইলচেয়ারে বসে সূর্য দেখছিলেন, পাখির গান শুনছিলেন; হঠাৎ এক মৌমাছি এসে তার কপালে হুল ফোটায়। তারপর আসে পুরো ঝাঁক।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এলি বলেন, ‘ওরা আমার চুলে, কানে, মাথায় কামড়ে যাচ্ছিল আমার চারপাশ কেবল গুনগুন শব্দে ভরে যাচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম, এটাই বুঝি আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত।’
এলি ছিলেন মৌমাছির বিষে অ্যালার্জিক। ছোটবেলায় একবার হুল ফুটে গিয়েছিল। তিনি চলে গিয়েছিলেন কোমায়। সেই অভিজ্ঞতার ভয় তাড়িয়ে বেড়াত। এবার পালানোর সুযোগ ছিল না। তার কেয়ারগিভার দৌড়ে পালালেও এলি পারলেন না। কেবল চুপ করে মুখ ঢেকে বসে রইলেন। এলির ভাষ্যে, ‘আমি শুধু ভাবলাম, এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি মরতে প্রস্তুত।’
তবে মৃত্যু নয়, এলি পেলেন পুনর্জন্ম। কেয়ারগিভারকে খবর দেওয়ার পর দ্রুত তাকে ঘটনাস্থল থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তবে এলি মারা যাননি; বরং হাসপাতালে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার শরীরে শুরু হয় তীব্র ব্যথা ও জ্বর। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, ‘এরিশ হ্যারেক্স হাইমার’ প্রতিক্রিয়া। দেহের ভেতরে থাকা বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া মরার সময় তাদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা টক্সিনের কারণে এটা হয়।
এই ঘটনার তিন দিন পর এলি লক্ষ করলেন তার ব্যথা কমে গেছে; যে ঘোরের মধ্যে ছিলেন, সেটা কেটে গেছে। শরীরের ব্যথা অনেকটাই কমে গেছে। স্মৃতিশক্তি ফিরছে, হাঁটতে পারছেন।
এই অলৌকিক ঘটনার পেছনে আছে শারীরতাত্ত্বিক বিজ্ঞান আর টক্সিকোলজির জাদু। মৌমাছির বিষে থাকে মেলিটিন নামে এক বিশেষ ধরনের পেপটাইড, যা ব্যাকটেরিয়ার কোষের ঝিল্লি গলিয়ে দেয়, বিশেষত বোরেলিয়ার ক্ষেত্রে। এটি এইচআইভির মতো জীবনগ্রাহী ভাইরাসের কোষও ভেদ করতে সক্ষম।
এলি নিজেই বিজ্ঞানী, তাই নিজেই শুরু করেন গবেষণা। খুঁজে পান ১৯৯৭ সালের একটি ছোট গবেষণা, যেখানে দেখা যায় মেলিটিন সরাসরি বোরেলিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে। এলি এরপর নিজের বাসায় শুরু করেন অ্যাপিথেরাপি বা নিয়মিত মৌমাছির হুল প্রয়োগ। প্রতিদিন ১০টি হুল, সপ্তাহে ৩ দিন। হাজার হাজার হুলের পর তিন বছর ধরে এলি হয়ে উঠলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। এখনো তিনি মাঝেমধ্যে হুল প্রয়োগ করেন শুধু বাড়তি রোগ প্রতিরোধের জন্য।
এখন তিনি একটি মৌ-খামারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছেন, যারা নিরাপদ ও প্রাণনাশহীন পদ্ধতিতে মৌমাছির বিষ সংগ্রহ করে। প্রতি গ্রাম বিষ সংগ্রহে লাগে প্রায় ১০ হাজার মৌমাছি। যার মূল্য সোনার চেয়েও দামি। এই বিষ এখন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাভেনের গবেষণাগারে। প্রাথমিক ফলাফল আশানুরূপ।
এলি লোবেলের জীবন যেন প্রকৃতির বিস্ময়ের এক অনবদ্য উদাহরণ। যেখানে মৃত্যু এসে জীবনকে ছুঁয়ে দেয়, সেখানে বিষ হয়ে ওঠে ওষুধ।
বিজ্ঞানীরা পুরোদস্তুর চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণা। উত্তর খুঁজছেন, কীভাবে এই বিষ কাজ করে? শুধুই কি ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলছে, নাকি ইমিউন সিস্টেমকে জাগিয়ে তুলছে?
এই গল্প সেই প্রবাদকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’।
সূত্রঃ বিবিসি ফিচার
এম.কে
৩০ জুন ২০২৫