ভারতের সঙ্গে টানাপড়েনের মধ্যে নতুন করে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে ব্রিটেনকে নিয়ে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে দেশটির অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ। যদিও পার্লামেন্টে দেয়া বক্তব্যে অনেক অসত্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে বলে প্রতিবাদ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ সরকার।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ব্রিটেনকে নিয়ে অস্বস্তির দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দেশটিতে অবস্থান করা আওয়ামী সমর্থকদের তৎপরতা। তারা লন্ডনে একটি বড়সড় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী ৮ই ডিসেম্বর সেই সমাবেশ হবে। যেখানে হাজারো নেতাকর্মীর উপস্থিতির চেষ্টা চলছে। অনুষ্ঠানের আয়োজক যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনাকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ দাবি করে তারা ওই আয়োজনের একটি পোস্টার করেছে, যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে হাসিনা বক্তব্য রাখবেন বলে প্রচার চালাচ্ছে। যদিও ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা। খোদ আশ্রয়দাতা ভারতই তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রিট করছে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ওই সমাবেশে শেখ হাসিনাকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত করার চেষ্টা করছেন আয়োজকরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাবেশটি হবে কিনা? বা তিনি আদৌ বক্তৃতা করবেন কিনা? তা নিয়ে এখনো যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ওই আয়োজনের ভেন্যু হিসেবে আপাতত ইস্ট লন্ডনের ইম্প্রেশন হল ঠিক হয়েছে। সেই সমাবেশ থেকে প্রবাসী সরকার গঠনেরও চেষ্টা করা হতে পারে বলেও আয়োজকরা বলছেন।
সেগুনবাগিচা দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, উপরোল্লিখিত বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুককে বুধবার ডেকেছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। সাধারণত যে কোনো বিষয়ে অসন্তোষ জানাতে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারকে অতিরিক্ত সচিব বা মহাপরিচালক পর্যায়ে ডাকা হয়। কিন্তু ব্রিটেন যেহেতু শুরু থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রকাশ্যে সাপোর্ট দিয়ে আসছে তাই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে উপদেষ্টা নিজেই রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কথা বলেছেন।
তাছাড়া ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বিষয়টিও বিবেচনায় ছিল। তাই দূতকে তলব নয় বরং উপদেষ্টা কথা বলার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন মর্মে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। হাইকমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে বিদায়ের পর উপদেষ্টা মিস্টার হোসেন গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বুধবারের সংবাদ ব্রিফিংয়ে কথা শুরু করেন এভাবে- ‘ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে আমি ডেকেছিলাম দুটো কারণে, ছোটো ছোটো দুটো ঘটনা ঘটেছে। একটা হচ্ছে, ২ তারিখে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কয়েকজন এমপি বক্তব্য দিয়েছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতির ওপরে এবং সেখানে কিছু মিসইনফরমেশন আছে, এটা আমি হাইকমিশনারকে জানিয়েছি এবং বলেছি যে, চারিদিকে যে তথ্যের প্রবাহ চলছে, সেটা থেকে মনে হয় যেন তারা তা নিয়েছেন। আর দুয়েকটা সংগঠন যারা কথাবার্তা বলেছেন, সেগুলো মোটামুটি ব্রিটেন-বেইজড।
এখানে যেটা পরিস্থিতি সেটার প্রতিফলন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘটেনি।’ উপদেষ্টা বলেন, আমি যেটা বলেছি, পার্লামেন্ট মেম্বাররা তো যা ইচ্ছা তা বলবেন। এটাতে কারও-ই কিছু করার নাই, আমাদেরও কিছু করার নেই। কিন্তু আমাদের অবস্থানটা তারা যেন তাদের চ্যানেলে তুলে ধরেন। উনিও (ব্রিটিশ হাইকমিশনার) বলেছেন, আপনারা আপনাদের মিশনের মাধ্যমে জানান, আমরাও জানাবো। অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের একটা বিবৃতি এসেছে বেশ বড়সড়। সেখানে খুব দুঃখজনকভাবে যেটা এসেছে, আমি বলেছিও তাকে যে আমরা খুবই কষ্ট পেয়েছি। সেখানে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, ৫ই আগস্টের পরে বেশি মৃত্যু হয়েছে। এ জিনিসটি পুরোপুরি মিথ্যা।
৫ই আগস্টের আগে নিহতের সংখ্যা দেখানো হয়েছে মোট ২৮০ জন! আমি বলেছি বিষয়টা মোটেও তা না। ৫ই অগাস্ট বা তার আগে অন্তত দেড় হাজার ছেলেমেয়ে মারা গেছেন। তার মধ্যে ৭৮০ জনের তো আমরা একেবারে বাই নেইম পরিচয় জানি। বাকি অনেকের পরিচিয় নিশ্চিত করা যায়নি। তবে ডেডবডি পাওয়া গেছে এবং তারা নিহত এতে কোনো সন্দেহ নেই। উপদেষ্টা বলেন, ৫ই আগস্টের পর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু রিপোর্টটা যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটা একেবারেই সঠিক নয়।
বরং দুঃখজনক যে, জুলাই-আগস্ট জুড়ে এখানে এত বড় বড় ঘটনা ঘটেছে, সেটার কোনো উল্লেখ নেই তাদের রিপোর্টে। এটাও উল্লেখ নেই যে এখানে বিপুলসংখ্যক ছাত্রকে রাস্তাঘাটে গুলি করে মারা হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি বলেছি, তারা তাদের কথা বলছেন কিন্তু আমাদের তো সত্যটা এবং বাস্তবতাটা জানাতে হবে। আমাদের অবস্থানটা ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকতে হবে। ব্রিটিশ দূতকে বলেছি আপনি একটু ব্যাখ্যা করুন আপনার সরকারের কাছে এবং আপনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে।
লন্ডন সমাবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে আয়োজক যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক বলেন, আমরা আশা করছি শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন এবং প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করবেন। তার সঙ্গে তাদের সরাসরি কথা হয়েছে কিনা? অর্থাৎ কীভাবে আমন্ত্রণ জানানো হলো? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিভিন্ন মারফতে যোগাযোগ হয়েছে। ওই সমাবেশের জন্য ব্রিটিশ গভর্মেন্টের অনুমতি নিয়েছেন কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, হলরুমে অনুষ্ঠানের অনুমতি লাগে না। কেবলমাত্র ১০ ডাউনিং স্ট্রিট এবং পার্লামেন্টের সামনে অনুষ্ঠান করতে অনুমতি লাগে। বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনাকে তারা এখানো কীভাবে ‘প্রধানমন্ত্রী’ বলে যে প্রচার চালাচ্ছেন? সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যমান সংবিধানে তো অন্তর্বর্তী সরকার বলে কিছু নেই। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেয়া পর্যন্ত তারা এমনটাই বলতে চান বলে জানান ওই নেতা।
এম.কে
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪