১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক-প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি। যেটা লেখা হয়েছে সেটা হলো সরকারি ভাষ্য, যা লেখা হয়েছে সেটা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মিথ্যা। বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর গতকাল বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
দেশের স্বাধীনতার ৫৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং পূর্বাপর ঘটনাবলি সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। ৯৩ বছর বয়সেও তিনি নিরলস চিন্তা, গবেষণা ও লেখায় সক্রিয় রয়েছেন। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ, ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার দৃঢ়তা জাতীয় যে কোনো সংকটে আমাদের সাহস ও শক্তি যোগায়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং এ নিয়ে বিতর্ক ও প্রকৃত সত্য আড়াল করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর বাসসকে বলেন, এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রথম থেকে এমনভাবে বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবই এ যুদ্ধের মহানায়ক। পরে তো শেখ হাসিনা এই স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা এমনভাবে বলত যেন, এটা তাদের পারিবারিক ব্যাপার, তাদের পরিবারই নাকি এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, ইতিহাসের এই যে আবর্জনা এখন পরিষ্কারের সময় হয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ কিভাবে শুরু হলো- এ প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ১৯৭১ এর মার্চের শুরু থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের চলমান আলোচনা ভেঙে যাওয়ায় এবং ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হামলার কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছাড়া দেশের মানুষ একটি অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেখ মুজিব সম্পর্কে এটা বলা যায় যে, তিনি আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এটা একটা ভুয়া কথা। আসলে তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সর্বোচ্চ আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নিজে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে।
শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি সম্পর্কে উমর বলেন, ৭ মার্চের যে বক্তৃতা, সাধারণত বলা হলো এটা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা, কারণ শেখ মুজিব বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম ইত্যাদি, কিন্তু দেখা যায় এইসব কথা একেবারেই ভুয়া ছিল।
উমর বলেন, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন তাদের বলছেন, তোমরা আমার ভাই। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বলছেন, তোমরা আমার ভাই। এই ধরনের স্ববিরোধী কথাবার্তা ৭ মার্চের বক্তৃতায় ছিল। বলা হচ্ছে, এ ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা হলো এই বক্তৃতা দেয়া হলো ৭ তারিখে, এরপরে ১৫ তারিখে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলো এবং এরপর থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দলবল ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপ-আলোচনা করল।
যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না? এমন প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দীন উমর বলেন, না আওয়ামী লীগের দিক থেকে যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তারা পুরোপুরি একটি সাংবিধানিক লাইনে এ সমস্যার সমাধান চাইছিল। তবে অন্যদিকে এ আশঙ্কাও ছিল যে একটা হামলা হতে পারে, ৭ মার্চের পর থেকে আওয়ামী লীগের লোকরা বেসামরিক প্রশাসন, রেডিও, টিভিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। কিন্তু আসল ক্ষমতা হলো সামরিক শক্তি, সেটা মোকাবিলা করার কোন প্রস্তুতি ছিল না। আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি ছিল একটা বায়বীয় ব্যাপার।
সবাইকে পালিয়ে যেতে বলে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে কেনো বাসায় থাকলেন, তার তো পালিয়ে গিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ শুরুর পরও তার বাসায় অবস্থানে পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন- এ প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দীন উমর বলেন, শেখ মুজিব আত্মসমর্পণের জন্য বাড়িতে বসে রইলেন। আওয়ামী লীগের লোকেরা এবং তাদের বুদ্ধিজীবীরা বলে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে, তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। আমি বলেছি, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন।
পাকিস্তানের জেলে থেকে শেখ মুজিব কি জানতেন দেশে কি হচ্ছে? এর জবাবে উমর বলেন, সেখানে পুরো যুদ্ধের সময় নয় মাস জেলে ছিলেন, সেখানে তাকে কোনো খবরের কাগজ দেয়া হয়নি, রেডিও টেলিভিশনের কোনো খবর তিনি দেখতে পারেননি। তিনি যুদ্ধের কোনো খবরই জানতে পারেননি। কারও সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা বা নেতৃত্ব দেয়া তো দূরের কথা, তিনি জানতেনই না যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
সূত্রঃ বাসস
এম.কে
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪