সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য বেরিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অর্থ বিষয়ক সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে। রোববার ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সংস্থাটি ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
২০২২ সালে উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের এক আবাসিক এলাকায় একটি সম্পত্তি বিক্রি হয় ১ কোটি ১০ লাখ পাউন্ডে, সবশেষ যার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩৮ লাখ পাউন্ড। রিজেন্টস পার্ক এবং লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে খুব কাছেই যুক্তরাজ্যের রাজধানীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকাগুলোর একটিতে অবস্থিত ওই সম্পত্তি, যেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে অভিজাত বেশ কিছু সাদা রঙের বাড়ি।
ব্লুমবার্গ বলছে, ওই সম্পত্তির মালিক বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক, বাসিন্দা কিংবা সরকারি কর্মচারীদের বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। এর অধীনে কর্পোরেশনগুলোর ক্ষেত্রেও বিদেশে তহবিল স্থানান্তরে বিধিনিষেধ রয়েছে। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু শর্তপূরণ সাপেক্ষে এ অনুমতি (তহবিল স্থানান্তর) দেয়া হয় বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছর ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল থেকে তার মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তির রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউসের করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটসে আবাসন; যেখানে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম বাংলাদেশি কমিউনিটির আবাসস্থল এবং লিভারপুলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন।
যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের প্রায় আড়াইশ সম্পত্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্লুমবার্গ বলছে, যখন এসব সম্পত্তি কেনা হয়, তখন যুক্তরাজ্যজুড়ে তীব্র আবাসন সংকট চলছিল এবং এর ৯০ ভাগই ছিল সদ্য তৈরি অর্থাৎ নতুন বাড়ি।
এই লেনদেনগুলো এমন এক সময়ে করা হয়েছিল, যখন রুশ ধনকুবেররা খুব সহজেই তাদের সম্পদ যুক্তরাজ্যে লুকিয়ে রাখতে পারছে—এমন সমালোচনার মুখে ব্রিটিশ সরকার সম্পত্তির বিদেশি মালিকানায় আরও স্বচ্ছতা দেখাতে চাইছিল। ২০২২ সালে ইউক্রেনে মস্কোর সামরিক অভিযানের পর যা আরও জরুরি হয়ে ওঠে।
দুর্নীতি বিরোধীরা বলছেন, রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ততা আছে এমন লেনদেন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের আইন আদৌ কার্যকর কি না, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এসব সম্পত্তির কারণে সেই প্রশ্নও উঠতে পারে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনেও সাইফুজ্জামানের অন্তত পাঁচটি সম্পত্তি খুঁজে পেয়েছে ব্লুমবার্গ। মিউনিসিপ্যাল প্রপার্টি রেকর্ডসের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, প্রায় ৬০ লাখ ডলার দিয়ে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে পুননির্বাচিত হয়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। মন্ত্রিসভায় পদ হারালেও, সংসদীয় জমি সংক্রান্ত কমিটির সভাপতির পদে বহাল আছেন তিনি।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে প্রাক-নির্বাচনী ঘোষণায় সাইফুজ্জামান তার মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন টাকা (দুই দশমিক চার মিলিয়ন ডলার) এবং তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯ লাখ ৯৩ হাজার ডলার বলে জানান। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে সম্পদের ঘোষণাপত্রে তার যুক্তরাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দেখাননি। মন্ত্রী হিসেবে ২০২২-২৩ সালে তার বেতন প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড হিসাবে দেখানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক ব্লুমবার্গকে বলেন, বাংলাদেশের বাইরে নিজের সম্পত্তির মালিকানা প্রসঙ্গে ব্লুমবার্গের পক্ষ থেকে মন্তব্য চেয়ে অনুরোধ করা হলেও তাতে সাড়া দেননি সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।
যুক্তরাজ্যের ২০১৭ সালের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং আইনে সংজ্ঞায়িত ‘পলিটিক্যালি এক্সপোজড পারসন (পিইপি)’ ক্যাটাগরিতে পড়েন সাইফুজ্জামান। এটি যুক্তরাজ্যে ব্যবসায়িক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত সম্পত্তির এজেন্ট, ঋণদাতা, প্রপার্টি আইনজীবী এবং অন্যদের ওপর পিইপি শনাক্ত করার কাজ করে। যদিও এসব ব্যক্তি সম্পত্তি কেনার মতো ব্যবসায়িক লেনদেনে নিযুক্ত থাকলে তাদের সম্পৃক্ততা অতিরিক্ত তদন্তের দাবি রাখে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্য সম্পত্তি কেনার সঙ্গে জড়িত আর্থিক সেবা ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ব্লুমবার্গ। এর মধ্যে উত্তর দিতে রাজি হওয়া সংস্থাগুলোর দাবি, লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে ‘বাণিজ্যিক গোপনীয়তার’ কারণে বিস্তারিত কিছু জানায়নি তারা।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২০৩ বিলিয়ন টাকার ব্যবসার বিষয়টি প্রথমবারের মতো সামনে আনে। যদিও টিআইবি কোনো মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করেনি, তবে তারা বলেছে, কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি তথ্য চায়, তাহলে তারা এর প্রমাণ দিতে প্রস্তুত।
ব্লুমবার্গ বলছে, দুর্নীতি মামলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এবং তাদের সম্পদ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের আশপাশে সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ‘সন্দেহজনক তহবিল’ সনাক্ত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার বাবা, প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ২০১৩ সালে রাজনীতিতে পা রাখেন। এর এক বছর পর ভূমি প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর নির্মাণ কোম্পানি আরামিট পিএলসি এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি-র বড় পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণ অনুসারে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার কিছু আত্মীয় সরাসরি বা সহায়ক সংস্থার মাধ্যমে এক ডজনেরও বেশি কোম্পানির ব্যক্তিগত শেয়ারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা নিয়ন্ত্রণকারী অংশীদারিত্বের মালিক। এই পোর্টফোলিওতে চারটি পাবলিক কোম্পানি রয়েছে, তাদের মধ্যে আরামিট এবং ইউসিবির সম্মিলিত বাজার মূলধন প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী ইউসিবি’র চেয়ারম্যান, যেটি ছয় বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ পরিচালনা করে। আরামিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও রুখমিলা জামান।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে আরামিট এবং ইউসিবি কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। এছাড়া মঙ্গলবার ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এ বিষয়ে সাইফুজ্জামানের মুঠোফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সূত্রঃ ব্লুমবার্গ
এম.কে
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪