যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক শক্তি জোরদারের পথে হাঁটছে, যেখানে ইউরোপ একই অঞ্চলে উন্মুক্ততা, স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে তাইওয়ানকেন্দ্রিক ‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’ রক্ষা এবং প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের নৌ-প্রভাব সীমিত করাই নতুন মার্কিন নিরাপত্তা কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এই অবস্থান ইন্দো-প্যাসিফিকে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গত ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হোয়াইট হাউজের ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ২০২৫’-এ যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ‘মুক্ত ও উন্মুক্ত’ রেখে বিদেশিপক্ষের কারণে আমেরিকান অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা আর বরদাস্ত করা হবে না। এই কৌশলকে চীনের তাইওয়ানমুখী আগ্রাসন ঠেকানো এবং দ্বীপটিকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে সুরক্ষিত রাখার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আলোকে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্কের ভারসাম্য পুনর্বিবেচনা করতে চায়। ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মেক্সিকোর মতো মিত্রদের এমন বাণিজ্য নীতি গ্রহণে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে, যা চীনের অর্থনীতিকে অভ্যন্তরীণ ভোগের দিকে ঠেলে দেবে। ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য এককভাবে চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য সামাল দিতে সক্ষম নয়।
নিরাপত্তা কৌশলপত্রে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের মূল লক্ষ্য হিসেবে চীনের উত্থান মোকাবিলায় মিত্রদের ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। ভারতকে এখানে ‘কেন্দ্রীয় সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকলেও ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একটি ‘মূল অংশীদার’ হিসেবে দেখলেও মার্কিন নিরাপত্তা কৌশলে বাংলাদেশ নিয়ে সরাসরি কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তবে এশিয়ার দেশগুলোতে সামরিক বাজেট বাড়ানোর আহ্বান এবং সীমান্ত সুরক্ষা জোরদারের পরিকল্পনার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, বিশেষ করে ভারত যেহেতু এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র।
কৌশলপত্রে অর্থনৈতিকভাবে পারস্পরিক লাভের কথা বলা হলেও অনেক বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র মূলত নিজের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায় এশিয়ায় শক্তি প্রদর্শন বাড়াতে চায়। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য ঠিক করে ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্যও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর কথা বলা হলেও, সেটি ‘নিজের স্বার্থ সুরক্ষার’ শর্তে।
ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা বাড়লে ভূ-রাজনৈতিকভাবে দিল্লির গুরুত্ব আরও বাড়বে। এতে ভারত মহাসাগরে সামরিক উপস্থিতি, প্রযুক্তি সহযোগিতা ও সরবরাহ শৃঙ্খলা জোরদার হবে, যার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশেও পড়বে। চীননির্ভর অর্থনীতির কারণে বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’—জাপান, তাইওয়ান, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া নিয়ে গঠিত এই কৌশলগত বৃত্ত—চীনা নৌ ও বিমান শক্তির প্রশান্ত মহাসাগরে অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই শৃঙ্খলের কেন্দ্রবিন্দু তাইওয়ান, যা পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে, তারা এমন সামরিক বাহিনী গড়ে তুলবে যা ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনের যেকোনো স্থানে আগ্রাসন প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। তবে একা নয়—মিত্র দেশগুলোর বন্দর ব্যবহার, সামরিক সুবিধায় প্রবেশাধিকার এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর আহ্বানও জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায়, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি আরও ‘কঠোর ও শক্তিশালী’ করা হবে।
এম.কে

