যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম প্রায়ই শরণার্থী হোটেলগুলোর বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা ছড়ায়। কখনও কখনও এইসব শরনার্থী হোটেলে আশ্রয়প্রার্থীরা শারীরিক আক্রমণের শিকারও হয়। কিন্তু বন্ধ দরজার পেছনে এমন মানুষরা বাস করে যারা কাজ, নিরাপত্তা এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো খাবার বেছে নেওয়ার স্বপ্ন দেখে।
মুহাম্মদ নামে একজন আফগান শরনার্থী যুক্তরাজ্যে আশ্রয় আবেদনের অনুমোদনের সিদ্ধান্ত পেয়েছেন এবং যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি পেয়েছেন। তবে নতুন একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে মুহাম্মদের জীবনে–তিনি যে বাজেটে হোটেল ইয়র্কশায়ারে কয়েক মাস ধরে থাকছেন, সেখান থেকে তাকে বের হয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার কোথাও থাকার ব্যবস্থা নেই।
তবুও, মুহাম্মদ আমাকে হোটেলের অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেন। আমি রিফিউজি কাউন্সিলে খণ্ডকালীন কাজ করি, যার ফলে মাঝে মাঝে শরণার্থী হোটেলগুলোতে যাই। এগুলো অদ্ভুত ও দুঃখজনক জায়গা। যারা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়, প্রতিবাদকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, এবং কখনও কখনও – যেমন গত বছরে – হামলারও শিকার হয়।
হোটেলের স্বয়ংক্রিয় দরজার বাইরে, পূর্ব আফ্রিকার দুই ব্যক্তি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সিগারেট খাচ্ছেন। ভেতরে, কাঠের মত দেখতে টেবিলের আশেপাশে মানুষ বসে আছে। এক যুবক, যিনি রাস্তার পাশে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন, ক্রাচে ভর দিয়ে কক্ষের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে হাঁটছেন।
“তারা সবাই প্রকৃত শরণার্থী,” মুহাম্মদ বলেন।
“এখানে থাকা প্রত্যেকেই কষ্ট পাচ্ছে।” কিন্তু বাইরে থেকে অনেকেই বিষয়টিকে এভাবে দেখে না। মুহাম্মদ এখানে মাত্র তিন মাস আছেন, কিন্তু ইতোমধ্যেই স্থানীয় সমাজের সঙ্গে হোটেলের বাসিন্দাদের মধ্যে বড় একটি ব্যবধান অনুভব করেছেন।
“তারা ভাবে অভিবাসীরা সবাই অপরাধী। হয়তো কেউ তাদের এটা বলেছে।” তিনি চান, মানুষ যেন বুঝতে পারে কেন কেউ আশ্রয়ের আবেদন করে,কিংবা নিজের দেশ ছেড়ে আসে।
আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর, মুহাম্মদ তার বোন এবং তার বন্ধুদের জন্য গোপনে ইংরেজি ও জীববিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন।
আফগান কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানতে পেরে গত বছর তাকে গ্রেফতার করে এবং সাতদিন আটক রাখে। এটা তার দ্বিতীয়বারের মতো কারাবাস – প্রথমবার তিনি নারী শিক্ষার পক্ষে একটি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন বলে ঘটেছিল।
তিনি বলেন, “আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, কারাগারে অনেক কিছু ঘটেছে। এসব কারণে যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) তৈরি হয়েছে, সেটা আমাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।”
কারাগারে দ্বিতীয়বার বন্দি হওয়ার আগে, মুহাম্মদ বিদেশে স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য আবেদন করেছিলেন এবং যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। তাই মুক্তি পাওয়ার পর, তিনি যুক্তরাজ্যে আসেন এবং আশ্রয় আবেদন করেন।
মুহাম্মদ ইতিমধ্যে একটি উচ্ছেদ নোটিশ পেয়েছেন এবং এখন কোথায় যাবেন, তা নিয়ে ভাবছেন।
তিনি শান্তভাবে বলেন, “সম্ভবত আমি গৃহহীনও হয়ে যাব।”
লেউল ও লেডো – দুই তরুণ ইরিত্রিয়ান, যারা খ্রিস্টান ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে পালিয়ে এসেছেন।
ইরিত্রিয়া একটি একনায়কতান্ত্রিক দেশ, যেখানে তাদের ধর্ম পালন নিষিদ্ধ এবং ধর্ম অনুসারীদের কারারুদ্ধ বা হত্যা করা হয়। এছাড়াও, দেশটির তরুণদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে পাঠানো হয়।
লেউল বলেন, “অধিকাংশ ইরিত্রিয়ানরা সরকার থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালায়।”
তার বাবা ধর্মীয় কারণে কারাবন্দি হলে, তিনি তার মায়ের সঙ্গে দেশ ছাড়েন। পরে প্রতিবেশী ইথিওপিয়ায় ছিলেন অনেকদিন, তার মা অবৈধভাবে ছোটখাটো জিনিস বিক্রি করছিলেন বলে ইথিওপিয়ান পুলিশের হাতে মারধরের শিকার হন।
লেউল জানান, তিনি অনেকদিন ধরে তার মায়ের কোনো খোঁজ পাননি।
তিনি দুই বছর ধরে বিভিন্ন দেশ পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে পৌঁছেছেন। তার যাত্রা ছিল বিভীষিকাময়, বিশেষ করে লিবিয়ার অবস্থা খুব খারাপ বলে জানান লেউল।
একজন তরুণ শরনার্থী বলেন, “ যুক্তরাজ্যের এই হোটেল আধুনিক কারাগারের মতো। আমরা কিছুই করি না – না কাজ, না পড়াশোনা, শুধু হোটেলে বসে থাকি।”
আবদুল্লাহ একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী, যিনি লেবাননে একটি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি জানান, সেখানে ফিলিস্তিনিদের কোনো মৌলিক অধিকার নেই – তারা কাজ করতে বা বাড়ি কেনার অনুমতি পায় না। যখন সেখানে সংঘাত শুরু হয়, তখন তাকে একটি সামরিক গোষ্ঠী যুদ্ধে যোগ দিতে বলে।
তিনি বলেন, “আমি যদি যোগ না দিতাম, তাহলে আমার জীবন ঝুঁকিতে থাকত।”
আজিজ নামের একজন আফগানি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের লোক। তিনি বলেন তিনি রাতে বাইরে হাঁটতে যান না, কারণ এক দোকানদার তাকে জানিয়েছিল তিনি ছুরিকাঘাতের শিকার হতে পারেন।
অন্য একজন শরনার্থী বলেন, তার এক আফগান বন্ধু গত বছরে হোটেলের বাইরে হামলার শিকার হয়েছিল এবং দুই সপ্তাহ হাসপাতালে কাটিয়েছিল।
সকল শরনার্থীরা জানায়, “কাজের সুযোগ পেলে, আমরা সমাজে অবদান রাখতে পারতাম।”
শরণার্থীদের মতে, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং কাজ করার অনুমতি পেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো। শরনার্থী হওয়া মানে এটি কোনো দেশ দখল করা নয় – এটি তাদের জীবনের জন্য নিরাপদ একটি জায়গা খোঁজা মাত্র।
লেখকঃ সোনিয়া ল্যাম্বার্ট
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
১৯ মার্চ ২০২৫