8.6 C
London
November 25, 2024
TV3 BANGLA
বাকি বিশ্ব

শিলিগুড়ি করিডোর কেন এতো গুরুত্বপূর্ণঃচিকেন নেক

এক দিকে বাংলাদেশ, আরেক দিকে নেপাল। মাঝখান দিয়ে সঙ্কীর্ণ এক অঞ্চলের নাম শিলিগুড়ি করিডোর । আবার জায়গাটির খুব কাছেই রয়েছে ভুটান ও চীনের সীমান্ত। যে কারণে করিডোরটি এই চার দেশের মাঝখানে পড়েছে। মাত্র ২২ কিলোমিটার চওড়া এই করিডোর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সাথে পুরো ভারতের যোগাযোগের একমাত্র পথ। ছোট্ট এই এলাকাটি কখনো শত্রুর দখলে গেলে সাতটি রাজ্যের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে নয়াদিল্লির। তাই এই করিডোরটি কৌশলগত দিক থেকে অনেক গুরত্বপূর্ণ। আকৃতিগত কারণে এটি পরিচিতি পেয়েছে চিকেন নেক বা মুরগির গলা হিসেবে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জেলার উত্তরাঞ্চলীয় শিলিগুড়ি শহরের কাছের একটি এলাকা এই শিলিগুড়ি করিডোর। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের এলাকা তেতুলিয়া আর নেপালের ভদ্রপুরের মাঝখানের সঙ্কীর্ণ জায়গাটুকুই এই করিডোর। এখানে বাংলাদেশ থেকে নেপালের দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। মাঝখানের এই জায়গাটুক ভারতের ভূখণ্ড।

এই এলাকাটির দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার আর প্রস্থে ২২ কিলোমিটার মাত্র। এত ছোট একটি জায়গার উপর দিয়েই ভারতকে তার উত্তর-পূবাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। মিজোরাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর ও সিকিমের সাথে ভারতের অবশিষ্ট অঞ্চলের যোগাযোগের একমাত্র পথ এটি। এখান দিয়ে একটি সড়ক ও রেলপথ চলে গেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। এই পথেই অঞ্চলটির সাথে বাণিজ্যিক, সামরিকসহ সব রকমের যোগাযোগ চালাতে হয় ভারতকে।

পূর্ব সীমান্তে চীনের সাথে যুদ্ধ বাধলে ভারত তাদের ৭টি রাজ্যে বাড়তি সৈন্য কিংবা রসদ পাঠাতে পারবে না এই করিডোরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে। যেটি ভারতের কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য সব সময়ই বড় চিন্তার বিষয় হয়ে আছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীও এই কারণে এই করিডোরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরাও বিভিন্ন সময় শিলিগুড়ি করিডোরের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের আশঙ্কা চীন কখনো ভারতের গলা চেপে ধরতে চাইলে স্পেশাল ফোর্স পাঠিয়ে শিলিগুড়ি করিডোরের দখল নিতে চেষ্টা করবে সবার আগে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যা ৫০ মিলিয়নের আশপাশে। তাদের একটি বড় অংশ ভাষা, সংস্কৃতি ও আচরণগত দিক থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কীত। নেপাল, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রভাব আছে তাদের মাঝে। অনেক অভিবাসী বাসিন্দাও আছে এই অঞ্চলে। যে কারণে তারা এমনিতেই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের লোকদের চেয়ে অনেকটা ব্যতিক্রম।

ভারত সরকার এই অঞ্চলটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না এমন অভিযোগ ও ক্ষোভ আছে ৭ রাজ্যের ভারতীয় নাগরিকদের মাঝে। এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ বহু বছরের পুরনো। নিরাপত্তা বাহিনীর উপর অস্ত্রধারীদের হামলা নিয়মিত ঘটনা। যে কারণে অঞ্চলটির সাথে নয়াদিল্লির যোগাযোগের একমাত্র করিডোরটি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে হয় ভারত সরকারকে। নয়াদিল্লি যদি চিকেন নেকের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় সেটি এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আরো উৎসাহিত করবে তাতে সন্দেহ নেই।

আবার এই করিডোরের অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। দার্জিলিংয়ের চা ও কাঠ শিল্প ভারতের অর্থনীতিতে বড় ভুমিকা রাখে প্রতি বছর। দার্জিলিংয়ের চায়ের যেমন খ্যাতি আছি পৃথিবীব্যাপী তেমনি এর আছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব; কিন্তু চিকেন নেকের কোন বিপদ ঘটে গেলে ভারত দার্জিলিংয়ের এই বিশাল অর্থনীতিও হারাবে।

তবে এই করিডোর নিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় আশঙ্কাটা মূলত সামরিক খাতেই। চীনের সাথে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরারবর ভারতের যে সড়ক ও রেলপথ, সেগুলো এই শিলিগুড়ি করিডোরের সাথেই সংযুক্ত। ওই অঞ্চলে কোন সামরিক সহযোগিতা পাঠাতে হলেও ভারতকে এই করিডোরের উপর নির্ভর করতে হয়।

এই করিডোরের উত্তর দিকের অংশটা এক সময় সিকিম নামে একটি স্বাধীন দেশ ছিলো। সিকিমের তিনদিকে নেপাল, ভুটান ও চীন। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের অংশ হয়ে যাওয়ার পর ভারত অনেকটা সুবিধা পেয়েছে শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে।

তবু পুরোপুরি দুঃশ্চিতামুক্ত হতে পারছে না ভারত শিলিগুড়ি করিডোর নিয়ে। এর কারণ শিলিগুড়ি করিডোরের থেকে তিব্বতের চুম্বাই উপত্যকার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। যেখানে মোতায়েন আছে চীনা সেনাবাহিনীর বিশাল বহর।

চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয় কয়েক যুগ ধরেই। সর্বশেষ ২০১৭ সালে লাদাখে দেশ দুটির সৈন্যরা যুদ্ধের প্রায় কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো। দুই দেশের সৈন্যদের মাঝে হাতাহাতিতে ভারতের কয়েক ডজন সৈন্য মারা গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। চীনা সৈন্যরাও হতাহত হয়েছিলেন ওই ঘটনায়। সামরিক পর্যায়ে অন্তত ১০ দফা সংলাপ করে ওই ঘটনা আপাতত থামিয়ে দেয়া গেলেও লাদাখে দুই দেশের উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশোমিত হয়নি।

যে কারণে চিকেন নেক নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ক্রমশই বাড়ছে। লাদাখে সংঘর্ষ বাধলে চীনের প্রথম টার্গেট হতে পারে শিলিগুড়ি করিডোর। ভারতীয় সামরিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, তিব্বত থেকে চীন কখনো যদি এই এলাকার উপর হামলা চালিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চেষ্টা করে- তাহলে বড় ধরণের বিপদে পড়বে ভারত।

গত কিছু বছর ধরে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় চীনা সেনাবাহিনী স্থাপনা তৈরি করছে। সড়ক ও বিমান ঘাঁটিও তৈরি করছে তারা। ভারত অনেকবার এর প্রতিবাদ করলেও কর্নপাত করছে না বেইজিং। যেটি চীন এই করিডোরের পাশে শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এসব এলাকায় কামান, মিসাইল ও এন্টি এয়ারক্রাফট ওয়েপন মোতায়েন করছে তারা। এর একটিই উদ্দেশ্য হতে পারে, কখনো যদি ভারতের সাথে চীনের সঙ্ঘাত বাধে, তা হলে তারা শুরুতেই চিকেন নেক দখল করবে এবং এর ফলে চীনের সীমান্তে আর সৈন্য, গোলাবারুদসহ কোন ধরণের রসদই পাঠাতে পারবে না ভারত।

শিলিগুড়ি করিডোরের দুই পাশের দুটি দেশ হলো নেপাল ও বাংলাদেশ। এই দুটি দেশর সাথেও ক্রমশ সম্পর্ক জোরদার করছে চীন। এই করিডোরের খুব কাছেই আরেকটি দেশ হলো ভুটান। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গত এক দশকে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের যে লড়াই চলছে, তাতে চীন বড় ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছে।

বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ছাড়া অন্য দেশগুলোকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। যেটি ভারতের নীতি নির্ধারকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।

ভারতের সাবেক সেনাকর্মকর্তা ও নদীয়া ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইগরো ফাউন্ডেশনের পরিচালক মহিন্দর পাল সিং টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, কোন সন্দেহ নেই যে, সঙ্ঘাতের সময় এই অঞ্চলটিই হবে শত্রুদের প্রথম ও প্রধান টার্গেট। তাই তো এই সরু করিডোর ও এর মধ্য দিয়ে যাওয়া সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ড- যা যে কোন মূল্যে সুরক্ষিত রাখতে হবে ভারতকে।

শিলিগুড়ি করিডোরের দুর্বলতার কারণেই ভারত এটিকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভারতীয় প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধরকরাও জানেন তাদের জন্য কত বড় একটি দুর্বলতা এই করিডোর। যে কারণে অঞ্চলটিতে সবসময়ই করা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ছাড়াও আসাম রাইফেলস, বিএসএফ এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এলাকাটির নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং – ‘র’ বিশেষ নজরদারি করে এই করিডোরের উপর এবং এর আশপাশে। এমনকি এই অঞ্চলের আশপাশে প্রতিবেশী দেশগুলোর যেসব নাগরিক বসবাস করে তাদের কর্মকাণ্ডের উপরেও কড়া নজর রাখা হয়। অর্থাৎ স্পর্শকাতর এই জায়গাটির নিরাপত্তায় ভারত কোন ছাড় দিতে রাজি নয়।

তবুও এই করিডোর নিয়ে তারা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কারণ কৌশলগত দিক থেকে জায়গাটি এতটাই ভঙ্গুর যে, শত্রুর প্রথম আঘাত আসতে পারে এই করিডোরের উপরই। আর তেমনটি হলে এক আঘাতেই দুর্বল হয়ে পড়বে ভারত।

সূত্রঃ টাইমস অব ইন্ডিয়া / স্যোশাল মিডিয়া

এম.কে
১১ আগস্ট ২০২৪

আরো পড়ুন

আগামী বছর হজে যেতে পারবেন ১ লাখ ২৭ হাজার বাংলাদেশি

প্রেসিডেন্টকে ঘুষের অভিযোগ প্রমাণে স্যামসং উত্তরাধিকারীর জেল

হাসিনার পতনের পর ৬০ শতাংশ বাজার হারিয়েছে কলকাতা