জামানত ও সংযোগ ফি জমা দেওয়ার ১১ বছর পরও গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় টাকা ফেরত নিচ্ছেন চট্টগ্রামের আবাসিক গ্রাহকেরা। নোটিশ ছাড়াই ২০১৫ সালের শেষে নতুন ও বর্ধিত গ্যাস সংযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর আগে ২০১৩ সালে গ্যাস সংযোগ পেতে ডিমান্ড নোট অন্যান্য সব খরচসহ প্রায় ৩০ কোটি টাকা কেজিডিসিএলকে দিয়েছিল গ্রাহকেরা।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত চট্টগ্রামের ২৫ হাজার গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক গ্রাহক ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরত নিচ্ছেন।
সংযোগ প্রদানে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে সংস্থাটির শীর্ষ এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা সরকারের জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের গ্যাস সংকট রয়েছে। আগে বিভিন্ন সোর্স থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস যুক্ত হতো। এখন গ্যাস সেক্টরটি এলএনজি নির্ভর। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১০০টি এলএনজি কার্গো আমদানি করে সরকার। এর মধ্যে কাতার ও ওমান থেকে আসে ৫০টির বেশি কার্গো।
কেজিডিসিএলের দক্ষিণ বিভাগের মহাব্যস্থাপক (বিক্রয়) প্রকৌশলী মো. রইছ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আবেদন করে ডিমান্ড নোট জমা দেওয়া অন্তত ৫০জন আবাসিক গ্রাহক তাদের টাকা ফেরত নিয়ে গেছেন। ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরত নিতে ২০২১ সালে নোটিফিকেশন করেছিল জ্বালানি বিভাগ।’
নাম প্রকাশ না করে কেজিডিসএলর অন্যতম শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। মূলত গুটিকয়েক এলপিজি (বোতলজাত গ্যাসের সিলিন্ডার) ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তৎকালীন সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী শিল্প কারখানাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নামে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেন। বিনিময়ে তিনি এলপিজি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।’
এদিকে কেজিডিসিএল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, কার্যত আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বৈধ উপায়ে বন্ধ থাকলেও অধিকাংশ গ্রাহক অবৈধ উপায়ে সংযোগ নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি পুরোনো গ্রাহকেরই বার্নার সংখ্যা রেড়েছে। ফলে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে আবাসিকে বন্ধ করার পর ২০১৩ সালের শেষের দিকে সাময়িকভাবে আবারও সংযোগ চালু করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের পর আবার জ্বালানি বিভাগ থেকে বিতরণ কোম্পানিকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করা হয়। পরে ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়।
এদিকে প্রায় এক যুগ ধরে আবাসিক খাতে বন্ধ থাকা গ্যাস সংযোগ চালুর দাবি জানিয়েছে আসছে চট্টগ্রাম গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি গ্রাহক ঐক্যজোট ও কেজিডিসিএল ঠিকাদার কল্যাণ সমিতি। একই সঙ্গে আবাসিক পর্যায়ে বিদ্যমান লাইন থেকে বর্ধিত সংযোগ চালু করারও দাবি জানান সংগঠন দুটির নেতারা।
চট্টগ্রাম গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি গ্রাহক ঐক্যজোটের এক নেতা বলেন, ‘গ্যাস সংযোগ না থাকার কারণে অনেকে বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না। বিশেষ করে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বাড়িগুলো গ্যাসের অভাবে ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।’
২০১৪ সালের ১৮ আগস্ট প্রকাশিত সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী, গ্রাহক ও কর্ণফুলী গ্যাস কর্তৃপক্ষের মধ্যে গ্যাস সংযোগের চুক্তি হওয়ার ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সার্ভিস লাইন তৈরি করে সংযোগ দিতে হবে। কিন্তু কর্ণফুলী গ্যাসের কতিপয় কর্মকর্তার অবহেলা ও যোগসাজশের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২৫ হাজার গ্রাহক এক যুগ ধরে গ্যাস সংযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এদিকে বিনা নোটিশে এক যুগ ধরে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখায় চট্টগ্রামের পাঁচশতাধিক ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার ব্যক্তি বেকার হয়ে পড়েছেন। তারা পরিবার নিয়ে দুর্বিষহ ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গ্যাস সংযোগ না পেয়ে গ্রাহকেরা ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের উত্তর ফতেয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সেলিম। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করেছি। ২০১৩ সালে ডিমান্ড নোট জমা দিয়েছি। ১১ বছরেও গ্যাস সংযোগ পাইনি। সরকার দশ বছর পর এসে ডিমান্ড নোটের ১২ হাজার টাকা ফেরত নেওয়ার কথা বলছে। চট্টগ্রামের ২৫ হাজার গ্রাহকের অন্তত ৩০ কোটি টাকা এক যুগ ধরে কেজিডিসিএলর কোষাগারে। কার কি লাভ হলো?’
কেজিডিসিএল সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে আবাসিক গ্রাহক (বার্নার) আছে ছয় লাখ, বাণিজ্যিক গ্রাহক ১৭০০ এবং ছোট-মাঝারি ও বড় এক হাজার শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ আছে। চট্টগ্রামে উক্ত তিন খাতে দৈনিক ২৮০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয় বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন।
এম.কে
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪