নিজ দেশে কারাগার ও নির্মম নির্যাতন এড়িয়ে পালিয়ে আসা আফ্রিকান নাগরিক উস্সু (ছদ্মনাম) যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছিলেন নিরাপত্তা ও একটি নতুন জীবনের আশায়। কিন্তু বাস্তবে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে টানা ১৭ বছর—যা তার জীবনে দ্বিতীয় এক দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ এই লড়াই জয় করে তিনি চলতি গ্রীষ্মে যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি (eVisa) পেয়েছেন।
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হওয়া উস্সুর জীবন উলটপালট হয় বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা চলাকালে। সেনাবাহিনীর ভেতরের দুর্নীতি ও দমননীতি তাকে কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে অংশ নিতে বাধ্য করে। বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং লোহার রড দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। দুই মাস সতেরো দিনের সেই বন্দি জীবন থেকে তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পালান।
পরিবার তাকে একটি ভুয়া পর্তুগিজ পাসপোর্ট জোগাড় করে দেয়, উদ্দেশ্য ছিল পর্তুগালে আশ্রয় চাওয়া। কিন্তু ফ্লাইট না পেয়ে তিনি অপ্রস্তুত অবস্থায় যুক্তরাজ্যে এসে পৌঁছান। ইংরেজি না জানা আতঙ্কগ্রস্ত উস্সু লুটন এয়ারপোর্টে ধরা পড়েন এবং ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহারের অভিযোগে জেলে যান। ভুল আইনি পরামর্শে দোষ স্বীকার করে বসায় ভবিষ্যতের পুরো মামলাই দুর্বল হয়ে পড়ে।
২০০৯ সালে জেল থেকে বেরিয়ে তিনি স্টকটনে আশ্রয় পান, কিন্তু সেখানে বর্ণবাদী হামলা ও বৈষম্যের মুখে পড়েন। তার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে হোম অফিসের অজ্ঞতার কারণে আশ্রয় আবেদন বারবার বাতিল হয়। বরখাস্ত হওয়া আইনি সহায়তা, দুর্বল কাগজপত্র ও ধারাবাহিক ভুল পরামর্শ তার মামলাকে আরও জটিল করে তোলে। কখনও ফেলে দেওয়া গদিতে রাত্রিযাপন, কখনও গির্জার আশ্রয়ে কাটানো রাত—এই দুর্দশা তার জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে।
২০১৩ সালে একটি সাইকেল পেয়ে তিনি বিনা ভাড়ায় চলাচল শুরু করেন, কিন্তু এক রাতে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হলেও শরণার্থী মর্যাদা নেই বলে দ্রুত ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। হাঁটতে অসমর্থ অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যাওয়ার সেই মুহূর্ত তাকে ভীষণভাবে আঘাত করে। পরে একটি দাতব্য সংস্থা আইনি হস্তক্ষেপ করে বৃদ্ধাশ্রমে অস্থায়ী আবাসন নিশ্চিত করে।
তার জীবনে মোড় আসে যখন নামকরা অভিবাসন আইনজীবী প্রতিষ্ঠান উইলসনস তার মামলাটি নতুন করে হাতে নেয়। চার বছরের আইনি লড়াইয়ের পর আদালত তার প্রতি বিশ্বাস দেখায় এবং সেই রায় হোম অফিসের আপিলেও বহাল থাকে। অবশেষে ১৭ বছরের অপেক্ষার পর তিনি যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি পান।
বর্তমানে লন্ডনের একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করে নিজের জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন উস্সু। ভবিষ্যতে নির্মাণশিল্পে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে। সন্তানদের সঙ্গে বহু বছর শুধু ভিডিও কলে কথা বলার পর এখন তাদের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং তাদের পড়াশোনার খরচ বহনে কঠোর পরিশ্রম করতে চান।
তিনি এখনও বলেন, “হোম অফিস আমার জীবন নষ্ট করেছে। ১৭ বছর ধরে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া আমাকে আটকে রাখা ছিল যেন খোলা কারাগার। তবুও আমি দাঁড়িয়ে আছি—কারণ কয়েকজন মানুষ আমাকে ভরসা দিয়েছে।”
জীবনের প্রায় দুই দশক হারানোর পরও উস্সু এখন আশায়—সমাজে অবদান রাখবেন, কর দেবেন, আর নতুন করে জীবন শুরু করবেন।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে

