মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অটো শিল্পে একের পর এক দেউলিয়া হওয়া প্রতিষ্ঠান অর্থনীতিতে নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের মতো পরিস্থিতি আবারও ফিরে আসতে পারে। তবে এবার মর্টগেজ নয়, মূল সংকট তৈরি হচ্ছে গাড়ি ঋণকে ঘিরে। বর্তমানে গাড়ি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এটি মর্টগেজ ঋণের মতো বিশাল না হলেও, যথেষ্ট বড় যাতে ডমিনো প্রভাব তৈরি করে গোটা অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে দিতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমেরিকানদের প্রকৃত আয় ক্রমেই কমছে। মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ খরচ এবং অস্থিতিশীল আয়ের কারণে অনেকে আর্থিক চাপে আছেন। এই পরিস্থিতিতে গাড়ি কেনাবেচা সচল রাখতে ঋণদাতারা ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ অনুমোদন করছেন। ইতিমধ্যে লাখো মানুষ সাবপ্রাইম গাড়ি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বৃহত্তর ঋণ সমস্যার প্রথম সতর্ক সংকেত, যা পরবর্তীতে মর্টগেজ ডিফল্টের মতো বড় বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।
কেবল ঋণগ্রহীতারাই নয়, গাড়ি শিল্পের বড় বড় কোম্পানিও বিপদে পড়ছে। সম্প্রতি গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাতা ফার্স্ট ব্র্যান্ডস চ্যাপ্টার ১১ দেউলিয়া সুরক্ষা চাইতে বাধ্য হয়েছে। এর আগে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সাবপ্রাইম গাড়ি ঋণদাতা ট্রাইকোলার হোল্ডিংস দেউলিয়া হয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। জুন মাসে মারেল্লি, যারা নিসান ও ক্রাইসলারের বড় সরবরাহকারী, দেউলিয়া ঘোষণা করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই দেউলিয়া হওয়ার ধারা কেবল শুরু, যা আরও বহু প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২০০৮ সালে আর্থিক খাত ভেঙে পড়েছিল ঝুঁকিপূর্ণ হাউজিং লোনের কারণে। তখন ব্যাংকগুলো এমন গ্রাহকদের মর্টগেজ ঋণ দিয়েছিল, যাদের সেই ঋণ শোধ করার সামর্থ্য ছিল না। পরিণতিতে ৩.১ মিলিয়ন আমেরিকান ঘরবাড়ি হারিয়েছিলেন, দেশজুড়ে ফোরক্লোজারের ঢল নামে। লেহম্যান ব্রাদার্স, বেয়ার স্টার্নস ও ওয়াশিংটন মিউচুয়ালের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে, এবং সার্কিট সিটি, লিনেন্স ’এন থিংস, বস্কোভসের মতো বড় খুচরা ব্র্যান্ডও বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৯ সালের পর থেকে গাড়ির দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। বর্তমানে একটি নতুন গাড়ির গড় দাম ৪৯,৯৬৮ ডলার, যেখানে মাসিক কিস্তি সাধারণত ৭৫০ ডলারের বেশি। প্রতি পাঁচজন ক্রেতার একজন মাসে ১,০০০ ডলারেরও বেশি দিচ্ছেন।
এ অবস্থায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ২৫ শতাংশ অটোমোটিভ শুল্ক বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। জেনারেল মোটরস জানিয়েছে, শুধু এ বছরই তাদের ক্ষতি হবে ৪–৫ বিলিয়ন ডলার, আর ফোর্ডের ক্ষতি প্রায় ২ বিলিয়ন। তবে খরচ সরাসরি ভোক্তার ওপর চাপানো না হলেও, তারা তা সামলাচ্ছে কর্মী ছাঁটাই ও লাভ কমিয়ে।
অতিরিক্ত খরচের চাপে গাড়ি হারানো এখন বাস্তবতা হয়ে উঠছে। শুধু গত বছরই ১.৬ মিলিয়ন আমেরিকান তাদের গাড়ি হারিয়েছেন রেপোসেশনের মাধ্যমে। তাছাড়া গাড়ি কেনার পর মেরামতের খরচও ২০২৫ সালের আগস্টে এক লাফে ১৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চাপ দীর্ঘমেয়াদে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে।
আগামী মডেলগুলোতেও দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে নির্মাতারা। ফোর্ড তাদের মেক্সিকোতে তৈরি গাড়ির দাম ২,০০০ ডলার বাড়িয়েছে, সুবারু বেস মডেলের দাম ১৬ শতাংশ বাড়িয়েছে, ভক্সওয়াগনও একই পথে হেঁটেছে। জরিপে দেখা গেছে, ৮২ শতাংশ ডিলার ইতিমধ্যেই তাদের শোরুমে গাড়ির দাম বাড়িয়েছে। টয়োটার উত্তর আমেরিকার সিওও মার্ক টেম্পলিন সতর্ক করে বলেছেন, “উল্লেখযোগ্য মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা টেকসই নয়।”
গাড়ি ঋণ খাতের এই সংকট ফেডারেল তদারকির ঘাটতির কারণেও আরও গভীর হচ্ছে। কনজিউমার ফাইন্যান্সিয়াল প্রোটেকশন ব্যুরো অটো ঋণদাতাদের ওপর নজরদারি কমিয়েছে ঠিক তখনই, যখন বাজার সবচেয়ে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। কনজিউমার ফেডারেশন অব আমেরিকার এরিন উইটে বলেছেন, “গুরুতর অটো লেন্ডিং চাপ বৃহৎ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য কয়লার খনিতে ক্যানারির মতো সতর্ক সংকেত।”
মার্কিন অটো শিল্পের এই অস্থিতিশীলতা ক্রমেই একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেউলিয়া হওয়া প্রতিষ্ঠান, ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা সংকট, বাড়তে থাকা গাড়ির দাম ও ঋণের চাপ—সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি দ্রুত সমাধান খোঁজা না হয় তবে এর অভিঘাত ব্যাংক, বিনিয়োগকারী ও সাধারণ আমেরিকান নাগরিকদের ওপর ভয়াবহভাবে পড়বে।
সূত্রঃ দ্য ডেইলি মেইল
এম.কে
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫