ইংলিশ চ্যানেলে নৌকাডুবিতে অভিবাসী মৃত্যুর ঘটনার একদিন পর অনিয়মিত অভিবাসন ইস্যুতে ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার৷
সোমবার ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে ইটালির রাজধানী রোমে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়৷ জর্জা মেলোনি এবং কিয়ার স্টারমার, দুই দেশের দুই শীর্ষ নেতাই অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ে নিজেদের অবস্থান ও ভবিষ্যৎ লড়াই নিয়ে আলাপ করেছেন৷ সম্প্রতি অভিবাসন নিয়ে ভয়াবহ দাঙ্গার মুখোমুখি হয় ব্রিটেন৷
নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অবশ্য পূর্ববর্তী ব্রিটিশ রক্ষণশীল সরকারের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছেন৷ বিপরীতে স্টারমার বলেছেন, তিনি অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলায় জর্জা মেলোনির নেওয়া পদক্ষেপে ‘আগ্রহী’৷
ইটালি ২০২৩ সালের নভেম্বরে আলবেনিয়া সাথে একটি বিতর্কিত চুক্তিতে সই করেছে৷ যেটিও আওতায় আলবেনিয়ায় দুটি কেন্দ্রের কাজ চলছে৷ যেখানে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের একাংশকে রাখা হবে৷
আলবেনিয়ায় রেখে সংশ্লিষ্টদের আশ্রয় আবেদন যাচাই করা হবে৷ যাদের আবেদন প্রত্যাখাত হবে তাদের নিজ দেশ ফেরত পাঠানো হবে৷ এছাড়া সুরক্ষা পাওয়া লোকেদের আলবেনিয়া থেকে ইটালিতে স্থানান্তর করা হবে৷
আলবেনিয়ার অভিবাসী কেন্দ্রগুলোর চলতি বছরের আগস্টের শুরুতে খোলার কথা থাকলেও এটি চালু করতে বিলম্ব হচ্ছে৷
সোমবার সকালে রোমে অভিবাসন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কেন্দ্র (এনসিসি) পরিদর্শন শেষে স্টারমার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘‘এখানে (ইটালিতে) অনিয়মিত অভিবাসন নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই আমি এটি কীভাবে ঘটেছে সেটি বুঝতে চাই৷’’
তিনি আরো যোগ করেন, ‘‘অভিবাসীদের মূল দেশগুলোর সাথেও বেশ কিছু কাজ হয়েছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করে আসছি যে এই সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায় হল মানুষের প্রস্থান বন্ধ করা৷’’
তবে ইটালিতে স্টারমারের এই সফর নিয়ে সমালোচনাও শুরু হয়েছে৷ ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কিম জনসন বলেন, কিয়ার স্টারমার ইটালির ‘নব্য-ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে চান’, এটি দুঃখজনক৷
অপরদিকে, ইটালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি অভিবাসন নিয়ে ‘ইটালীয় মডেলের প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে সন্তুষ্টি’ জানিয়েছেন৷
অনিয়মিত অভিবাসন কমাতে আলবেনিয়ার সাথে হওয়া চুক্তি ছাড়াও ইটালি টিউনিশিয়ার সাথে আরেকটি চুক্তি সই করেছে৷ যেখানে অভিবাসীদের প্রস্থান কমাতে টিউনিশিয়াকে বর্ধিত প্রচেষ্টার বিনিময়ে আর্থিক সহায়তা প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়৷ এছাড়া লিবিয়ার সাথেও চুক্তি আছে ইটালির৷
ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, সমুদ্রপথে অভিবাসীদের আগমন চলতি বছরের শুরু থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে৷ ১ জানুয়ারি থেকে ১৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৪৪ হাজার ৬৭৫ জন অভিবাসী ইটালিতে এসেছেন৷ যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ৮০৬ জন৷
তবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এবং ভূমধ্যসাগরে সক্রিয় এনজিওগুলোর মতে, ইটালিতে অভিবাসীদের সংখ্যা কমার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে৷ অনেক অভিবাসী ইইউতে প্রবেশের জন্য তাদের রুট পরিবর্তন করেছেন৷
ইইউ সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স অনুসারে, বছরের প্রথম আট মাসে ইইউ সীমান্ত অতিক্রমকারী অনিয়মিত অভিবাসীদের ‘শনাক্তকরণ’ ৩৯ শতাংশ কমেছে৷
স্টারমার-মেলোনি বৈঠকের কয়েক ঘন্টা আগে ব্রিটেন নিজ দেশের সীমানা সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে একটি বিশেষ এলিট বাহিনী প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে৷ যেটি সবশেষ ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে কিয়ার স্টারমারের প্রচারাভিযানে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল৷
চলতি বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্য সবচেয়ে বড় দাঙ্গার মুখোমুখি হয়৷ যেটি ২০১১ সালের পর সবচেয়ে বড় দাঙ্গার ঘটনা৷ অভিবাসন ও মুসলিম ইস্যুকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছিল৷
২০২৪ সালের শুরু থেকে ফরাসি উপকূল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে নিহত হয়েছে অন্তত ৪৬ জন অভিবাসী৷ ব্রিটেনের নতুন সরকারের জন্য এটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
নতুন বাহিনীটির নাম দেয়া হয়েছে ‘এলিট বর্ডার সিকিউরিটি কমান্ড’৷ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে এটিকে অনুমোদন দেয়া আছে। এছাড়া সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, মানবপাচার নেটওয়ার্ক এবং সংগঠিত অপরাধ ট্র্যাক করার সক্ষম হবে নতুন এই বাহিনী৷
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিট জানিয়েছে, “এই নতুন কাঠামো অভিবাসনের সাথে যুক্ত সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে যৌথ তদন্ত চালাবে৷ আমাদের সকল পুলিশ বিভাগ এবং গোয়েন্দা পরিষেবাগুলো নতুন বাহিনীর সাথে সমন্বয় করবে৷’’
এই কমান্ডের নেতৃত্ব দেবেন ব্রিটেনের সিনিয়র পুলিশ অফিসার মার্টিন হিউইট৷ ডাউনিং স্ট্রিট উল্লেখ করেছে, ‘‘এই কর্মকর্তার গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ৩০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ সন্ত্রাস, সংগঠিত অপরাধ এবং অনিয়মিত অভিবাসনসহ নিরাপত্তা হুমকি নিয়ে জাতীয় প্রতিক্রিয়া গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন৷’’
২০২৪ সালে চ্যানেলে অভিবাসী মৃত্যুর সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে৷ ব্রিটিশ হোম অফিস বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ৪০০ অভিবাসী ব্রিটিশ উপকূলে পৌঁছেছেন৷ ২০২৩ সালের একই সময়ে এই সংখ্যাটি ছিল ২১ হাজার৷
ফ্রান্সের সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা ইংলিশ চ্যানেলে চলমান গুরুতর অভিবাসন সংকট নিয়ে যুক্তরাজ্যের সাথে নতুন চুক্তির আহবান জানিয়েছেন৷
সূত্রঃ রয়টার্স / এএফপি
এম.কে
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪