উত্তর আয়ারল্যান্ডের বালিমিনা শহরে রোমানিয়ান দুই কিশোরকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর শুরু হওয়া অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ দ্রুতই সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। পরপর চার রাত ধরে চলা দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত ৪০ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন এবং ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সবচেয়ে তীব্র সহিংসতা দেখা যায় মঙ্গলবার রাতে বালিমিনায়, যখন শত শত মুখোশধারী দাঙ্গাকারী পুলিশের ওপর ইট-পাথর, আতশবাজি ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় গাড়ি ও ভবনে। পুলিশ জলকামান ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।
সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী শহর পোর্টাডাউন, লার্ন, কোলরেইন, নিউটাউনঅ্যাবি, ক্যারিকফারগাস, আন্ট্রিম ও লিসবার্নে। লার্ন শহরে একটি লেজার সেন্টারে আগুন লাগানো হয়, যেখানে বালিমিনার সহিংসতার পর অভিবাসী পরিবারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।
বালিমিনায় Clonavon Terrace এলাকায় শুরু হওয়া বিক্ষোভ শুরুতে শান্তিপূর্ণ হলেও পরে কিছু মুখোশধারী বিক্ষোভকারী বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যারিকেড গড়ে এবং অভিবাসীদের বাড়ি ও পুলিশকে লক্ষ্য করে আক্রমণ শুরু করে। শহরের অনেক স্থানীয় বাসিন্দা তাদের জানালায় “British household” বা “Locals live here” সাইন লাগিয়ে হামলার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
বালিমিনার অনেক জাতিগত সংখ্যালঘু পরিবার ইতোমধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এক অভিবাসী মা মিকা কোলেভ বলেন, “আমার মেয়ে এখানে জন্মেছে, আমি এখানেই থাকি। কিন্তু এখন আমার নিজের ঘরে আমি নিরাপদ বোধ করছি না।”
এই সহিংসতার পেছনে কারা জড়িত তা এখনো নিশ্চিত নয়। যদিও এলাকাটি ঐতিহ্যগতভাবে ইউনিয়নিস্ট ও লয়ালিস্টদের ঘাঁটি, গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে কিছু ক্যাথলিকও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। তবে মানবাধিকার সংস্থা CAJ জানিয়েছে, এই ধরনের সহিংসতা সাধারণত লয়ালিস্ট প্রভাবাধীন এলাকায় ঘটে থাকে এবং এসবের পেছনে অনেক সময় চরম ডানপন্থী ও প্যারামিলিটারি গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা থাকে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় CAJ তুলে ধরেছে, ২০২৩ সাল থেকে উত্তর আয়ারল্যান্ডে সাতটি বড় অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে গ্রীষ্মকালে – ঐতিহ্যবাহী লয়ালিস্ট মার্চিং সিজনের সময়ে। সংগঠনটির মতে, এসব সহিংসতার সঙ্গে দারিদ্র্য বা অভিবাসীর সংখ্যা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়, বরং এগুলো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও আদর্শিক গোষ্ঠীর পরিকল্পিত কার্যক্রম।
উত্তর আয়ারল্যান্ডে অভিবাসনের হার তুলনামূলকভাবে কম। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, ২০২১ সালে ৮.৬% মানুষ বিদেশে জন্মগ্রহণকারী, যা ২০১১ সালে ছিল ৬.৫%। জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের হার মাত্র ৩.৪%, যেখানে ইংল্যান্ডে তা ১৮.৩%।
সরকারি কর্মকর্তারা সহিংসতা নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রথম মন্ত্রী মিশেল ও’নিল এই ঘটনাকে “ঘৃণ্য এবং অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত” বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থমন্ত্রী জন ও’ডোড হামলাকারীদের “জাতিবিদ্বেষী সন্ত্রাসী” বলে অভিহিত করেন। পুলিশের প্রধান কনস্টেবল জন বাউচার বলেন, “এই ধরনের ঘৃণাজনিত হামলা সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।”
তবে ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির (DUP) কয়েকজন নেতা সরাসরি দাঙ্গার নিন্দা করলেও অভিবাসন নীতির সমালোচনার আড়ালে দায় সরকারের ঘাড়েই চাপানোর চেষ্টা করছেন। DUP বিধায়ক পল ফ্রিউ বলেন, “বালিমিনায় দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ ছিল।”
সমাজতত্ত্ববিদ জন নাগেল বলেন, “বেশ কিছু ইউনিয়নিস্ট রাজনীতিক দাঙ্গা নিন্দা করলেও একইসঙ্গে বালিমিনাকে ‘অভিবাসীদের ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ হিসেবে চিত্রিত করছেন, যা সহিংসতাকে বৈধতা দিতে পারে।”
একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণের মধ্যে অভিবাসীদের প্রতি মনোভাবের অনেক উন্নতি হয়েছে। ২০২৪ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, উত্তর আয়ারল্যান্ডের ৯৪% মানুষ তাদের এলাকায় সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর কাউকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত, যা ২০০৫ সালে ছিল মাত্র ৫৩%।
সমাজতত্ত্ববিদ রুথ ম্যাকআরি বলেন, “অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, কল্যাণব্যবস্থার সংকোচন ও দ্রুত জনসংখ্যাগত পরিবর্তন—সব মিলিয়ে একটি সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে, যার প্রভাব আমরা রাস্তায় দেখতে পাচ্ছি।”
সূত্রঃ আল জাজিরা
এম.কে
১৬ জুন ২০২৫