মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহর অতিবৃষ্টির কারণে ডুবে গেল। দুবাই শহরের রাস্তাঘাট-বসতবাড়ি থেকে শুরু করে বিমানবন্দর পর্যন্ত ডুবল পানিতে।
সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিনেই প্রায় এক বছরের সমান বৃষ্টিপাত হয়েছে দেশটিতে। গত ৭৫ বছরে এমন বৃষ্টিপাত দেখেনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির বাসিন্দারা। আবু ধাবির আল আইনে ২৫০ মিলিমিটার এবং দুবাইয়ে ১২০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত শুধু শহরগুলোর স্বাভাবিক জীবন-যাপনের গতিকেই ধীর করে দেয়নি, এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সম্পর্কেও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে বছরে গড়ে ১৪০-২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় এবং গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে। এতে দেশটিতে পানীয় জলেরও ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। দেশটি মাটির নিচের পানির উৎসের উপর বেশি নির্ভরশীল।
এই পানি সংকট মেটানোর জন্যই আরব আমিরাত আবার উদ্ভাবনী সমাধানের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠে। এর মধ্যে একটি হল ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করা, যা বৃষ্টিপাত বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃত্রিমভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনের একটি রূপ।
ক্লাউড সিডিং এমন একটি কৌশল, যাতে আকাশে জলীয়বাষ্পের ঘনীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা এবং বৃষ্টিপাত ঘটাতে আকাশে মেঘমালার মধ্যে ‘সিডিং এজেন্ট’ বা রাসায়নিক উপাদান ছড়ানো হয়।
আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা প্রথমে বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে জলীয়বাষ্পের ঘনীভূত হওয়া বা পানিতে রূপান্তরের ধরনের ওপর ভিত্তি করে সিডিং এজেন্ট ছড়ানোর জন্য উপযুক্ত মেঘমালা শনাক্ত করে। এরপর বিমান পাঠিয়ে সেখানে সিডিং এজেন্ট বা রাসায়নিক উপাদান ছড়িয়ে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি তৈরি করা হয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৯৮২ সালে প্রথম ক্লাউড সিডিং পরীক্ষা করে। আর ১৯৯০-র দশক থেকে নিয়মিতভাবে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি নামানো শুরু করে।
২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রিসার্চ (এনসিএআর), দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটারসর্যান্ড ইউনিভার্সিটি এবং নাসার সঙ্গে যৌথ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার মাধ্যমে দেশটির কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের কর্মসূচি আরও শক্তিশালী হয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল সেন্টার অফ মেটিওরোলজি (এনসিএম) পরিচালিত রেইন এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএইআরইপি) এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দেয়। বর্তমানে দেশটিতে বছরে প্রায় ১ হাজার ঘন্টা কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়।
বিজ্ঞানীরা প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বায়ুমণ্ডলের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলো, বিশেষত অ্যারোসল বা বায়ুকণা ও দূষণকারী উপাদানগুলোর গঠন এবং মেঘ গঠনের উপর সেগুলোর প্রভাব বিশ্লেষণ করেন। ওই বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে মেঘ বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের জন্য একটি উপযুক্ত মেঘমালা সনাক্ত করা হয়।
উপযোগী মেঘমালা সনাক্ত করার পর হাইগ্রোস্কোপিক ফ্লেয়ার (অগ্নিশিখা) সজ্জিত বিশেষ বিমান আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। উড়োজাহাজের পাখায় লাগানো এই ফ্লেয়ারগুলোতে লবণের উপাদান থাকে। মেঘের উপরে পৌঁছানোর পরে অগ্নিশিখাগুলো জ্বালানো হয়, যা মেঘে সিডিং এজেন্ট তথা লবণ কণা ছড়িয়ে দেয়।
লবণ কণাগুলো নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে, যার চারপাশে জলীয়বাষ্প পানির ফোঁটা আকারে ঘনীভূত হয় এবং একসময় বৃষ্টির আকারে মাটিতে নেমে আসে।
এনসিএম আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য সমগ্র সংযুক্ত আরব আমিরাতজুড়ে একটি জাতীয় নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। এতে ৮৬টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন, ছয়টি আবহাওয়া রাডার ও একটি আপার এয়ার স্টেশন রয়েছে। কেন্দ্রটির বিাশাল আকারের জলবায়ু তথ্যভাণ্ডারও আছে। সর্বোচ্চ নির্ভুলভাবে সংখ্যাসূচক আবহাওয়ার পূর্বাভাস তৈরিতে সহায়তা করেছে কেন্দ্রটি।
বর্তমানে এনসিএম ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য আল আইন বিমানবন্দর থেকে চারটি বিচক্র্যাফট কিং এয়ার সি৯০ বিমান পরিচালনা করে। বিমানগুলো বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণার সর্বশেষ প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত।
ক্লাউড সিডিংয়ের উপকারিতা সত্ত্বেও এর পরিবেশগত প্রভাব এবং এতে ব্যবহৃত সিডিং এজেন্ট বা রাসায়নিকগুলো কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে উদ্বেগ বরাবরই থাকছে। তাই এনসিএম তার কৃত্রিম বৃষ্টি কর্মসূচির কার্যক্রমের সুরক্ষার পাশাপাশি কতটা টেকসই, তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে।
অনেক দেশে ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য সিলভার আয়োডাইডের মতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। স্ফটিক-সদৃশ এই রাসায়নিক উপাদানটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত এই ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। তার পরিবর্তে তারা প্রাকৃতিক লবণকে সিডিং এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে।
সম্প্রতি এনসিএম টাইটানিয়াম অক্সাইডের প্রলেপযুক্ত সূক্ষ্ম লবণ কণা দিয়ে নিজস্ব সিডিং এজেন্ট তৈরি করেছে, যা ন্যানো উপাদান হিসেবে পরিচিত। বৃষ্টিপাত বাড়ানোর ক্ষেত্রে উপাদানটির কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
তবে প্রকৃতির ওপর এমন হস্তক্ষেপ নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি এই অঞ্চল প্রায়ই ঝড় এবং ভারি বৃষ্টিপাতের মতো ব্যতিক্রমী আবহাওয়া পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, যার ফলে অভূতপূর্ব বন্যারও সৃষ্টি হয়।
তাই কেউ কেউ প্রাকৃতিক নিয়মে হস্তক্ষেপ না করার জন্য সতর্ক করেছেন। অনেকের দাবি, এই আকস্মিক ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যা হল প্রকৃতির প্রতিশোধ।
মঙ্গলবার ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনেও এই অতিবৃষ্টির জন্য ক্লাউড সিডিংকে দায়ী করা হয়েছে। আহমেদ হাবিব নামের এক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞের বরাতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ঝড়-বৃষ্টির আগের দুই দিনে এনসিএম এর বিমানগুলো আকাশে অন্তত সাতটি ক্লাউড সিডিং মিশন পরিচালনা করে।
তবে, মঙ্গলবার দেশজুড়ে ভারি বৃষ্টিপাত ও দুবাইয়ের বন্যার আগে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঝরানোর কোনও চেষ্টার কথা স্বীকার করেনি এনসিএম।
এনসিএমের উপপরিচালক জেনারেল ওমর আল ইয়াজিদি বলেছেন, মঙ্গলবারের এই ঝড়-বৃষ্টির আগে কোনও ক্লাউড সিডিং অপারেশন চালানো হয়নি।
তিনি আরও বলেন, “ক্লাউড সিডিংয়ের একটি মৌলিক নীতি হলো, বৃষ্টি হওয়ার আগে মেঘকে তার প্রাথমিক পর্যায়ে টার্গেট করতে হবে, যদি প্রচণ্ড বজ্রপাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে আর কোনও সিডিং অপারেশন পরিচালনা সম্ভব নয়।”
সিএনএন জানিয়েছে, মঙ্গলবার যে ভারি বর্ষণ আরব আমিরাত ও দুবাই শহরের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেছে, তা আরব উপদ্বীপের মধ্য দিয়ে যাওয়া এবং ওমান উপসাগর জুড়ে তৈরি হওয়া একটি বড় ঝড়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
এদিন প্রতিবেশী ওমান ও দক্ষিণ-পূর্ব ইরানেও ভারি বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। কিছুদিন আগে ওমানেও ভারি বর্ষণে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল, যার ফলে প্রায় ১৮ জন মানুষ প্রাণও হারায়। ওমানও কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঝরানোর জন্য প্রায়ই ক্লাউড সিডিং করে বলে জানা গেছে।
যাই হোক, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং গ্রান্থাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের অধ্যাপক ফ্রেডেরিক অটোর মতো অনেক বিজ্ঞানী এই অস্বাভাবিক ঝড়-বৃষ্টিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফল হিসেবেই দেখছেন।
সূত্রঃ সিএনবিসি
এম.কে
১৮ এপ্রিল ২০২৪