ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সর্বোচ্চ বিচারক লেডি সু ক্যার যুক্তরাজ্যের বিরোধীদলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার-কে উদ্দেশ্য করে করা বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে কেমি ব্যাডেনক-এর সংসদীয় প্রশ্নোত্তর পর্বে (PMQs) একটি ফিলিস্তিনি পরিবারের আশ্রয় সংক্রান্ত আলোচনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
লেডি ক্যার কনজারভেটিভ নেতার সেই প্রশ্নের সমালোচনা করেছেন, যেখানে গাজার একটি পরিবার ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য নির্ধারিত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের আবেদন করেছিল।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তকে ভুল বলে মন্তব্য করেছেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘এই ফাঁকফোকর বন্ধ করতে কাজ করছেন’— এটিও গ্রহণযোগ্য নয়।
লেডি ক্যারের সমালোচনার জবাবে কনজারভেটিভ নেত্রী ব্যাডেনক বলেন, রাজনীতিকদের অবশ্যই এমন মামলার রায় নিয়ে আলোচনা করার স্বাধীনতা থাকা উচিত।
তিনি বলেন, “সংসদ সার্বভৌম। রাজনীতিবিদদের সংসদে গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করার অধিকার থাকতে হবে।”
গত সপ্তাহের বিতর্কটি সেই রিপোর্টের সূত্র ধরে হয়েছিল যেখানে দেখা যায়, এক অভিবাসন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সেপ্টেম্বর মাসে ওই পরিবারের আবেদন খারিজ করেছিলেন, তবে উচ্চ ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা আপিল গ্রহণ করেন।
লেডি ক্যার বলেন, “আমি সংসদীয় বিতর্কের এই অংশ শুনে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়েছি এবং বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি লিখেছি। বিরোধীদল থেকে প্রশ্নটি উত্থাপন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার ধরণ দুটোই অগ্রহণযোগ্য।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারের উচিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান ও সুরক্ষা প্রদান করা। যদি কোনো পক্ষ— কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হয়, তবে তা আপিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবিলা করা উচিত।”
তিনি স্টারমার ও বিচারমন্ত্রী শাবানা মাহমুদের কাছেও চিঠি পাঠিয়েছেন বলে জানা যায়।
এই মামলাটি গাজার এক পরিবারের, যাদের বাড়ি ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে। তারা ২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পরিবারের এক সদস্যের কাছে যাওয়ার জন্য ইউক্রেন ফ্যামিলি স্কিমের আওতায় আবেদন করেছিলেন।
প্রথমে হোম অফিস তাদের আবেদন মে ২০২৩-এ খারিজ করে, কারণ তারা এই স্কিমের শর্ত পূরণ করতে পারেননি।
স্টারমার সংসদে বলেন, “আমি এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই। এটি ভুল সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও বলেন, “ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত নিয়ম তৈরি করা উচিত সংসদের, সরকারকে নীতিনির্ধারণ করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যেই আইনি ফাঁক বন্ধ করতে কাজ করছেন।”
ব্যাডেনক পরে X (সাবেক টুইটার)-এ পোস্ট করে জানান, তার বক্তব্যের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি ছিল না।
তিনি লেখেন, “এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা লঙ্ঘন নয়। গাজার এক পরিবারকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল নিন্দনীয়, এবং একাধিক কারণে এটি ভুল।”
শ্যাডো হোম সেক্রেটারি ক্রিস ফিলিপ বলেন, রাজনীতিকদের বিচারকদের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে।
শ্যাডো জাস্টিস সেক্রেটারি রবার্ট জেনরিক মন্তব্য করেন, “আইনের শাসনের নীতি অপব্যবহার করা হচ্ছে। আইনজীবীদের শাসন চালানোর অধিকার ছিল না, আর এটি কখনও আইনের শাসনের অর্থ হতে পারে না।”
লেডি ক্যারের এই হস্তক্ষেপকে কিছু উচ্চপদস্থ আইনি বিশেষজ্ঞরাও সমালোচনা করেছেন।
রাইট-উইং থিঙ্ক ট্যাংক পলিসি এক্সচেঞ্জের জুডিশিয়াল পাওয়ার প্রজেক্টের প্রধান রিচার্ড একিন্স কে.সি বলেন,
“এটি অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার মধ্যে সাম্প্রতিক সংসদীয় তর্ক বিনিময়ে সংবিধান লঙ্ঘনের কিছুই নেই। বিচারকদের সমালোচনা করা যাবে না, এমনটি বলা ভুল, এবং লেডি ক্যার বিচারকদের সমালোচনা বন্ধ করার যে চেষ্টা করছেন, তা ঠিক নয়।”
সাবেক বিচারমন্ত্রী রবার্ট বাকল্যান্ড বলেন, “রাজনীতিকরা অবশ্যই বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন, তবে এটি দায়িত্বশীলভাবে করা উচিত।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে অনেক বিচারক ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, যা উদ্বেগজনক।”
লেডি ক্যার আরও বলেন, “বিচারকদের শুধুমাত্র তাদের কাজ করার কারণে ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হওয়া উচিত নয়। তারা প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করেন।”
তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালে বিচারক প্যাট্রিক পেরাসকোকে আক্রমণের ঘটনা—যেখানে একজন অভিযুক্ত আদালতে তার দিকে ভারী বস্তু ছুঁড়ে মেরেছিল—এই বিষয়টিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে।
ব্যাডেনক যে মামলাটি PMQs-এ উল্লেখ করেছিলেন, তাতে প্রথমে অভিবাসন ট্রাইব্যুনাল পরিবারটির আবেদন নাকচ করে কারণ এটি ইউক্রেন শরণার্থী কর্মসূচির আওতায় পড়ছিল না।
তবে আপার ট্রাইব্যুনালের বিচারক পরে পরিবারটিকে মানবাধিকারের ভিত্তিতে (ECHR অনুযায়ী পরিবারে থাকার অধিকার) যুক্তরাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দেন।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫