ফৌজদারি মামলা তদন্তের জন্য পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এই সংস্থা হবে পুলিশ বাহিনী থেকে স্বতন্ত্র একটি কাঠামো।
প্রস্তাব অনুযায়ী, পুলিশের বদলে মামলার তদন্ত করবেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা। তদন্তকাজ তদারক করবেন সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটর। অর্থাৎ ফৌজদারি মামলা তদন্তের ভার আর পুলিশের কাছে থাকবে না। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের এই প্রস্তাবসংবলিত সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে দিয়েছে। পুলিশ বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ফৌজদারি মামলার তদন্ত করে।
সংস্কার কমিশনের সূত্র বলছে, ফৌজদারি মামলায় আসামির সাজা নির্ভর করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর। তবে এই তদন্তে কখনো কখনো পক্ষপাত, অসম্পূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বলতার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এসব কারণে কখনো কখনো প্রকৃত আসামির সাজা হয় না, নির্দোষ ব্যক্তি ফেঁসেও যান। তাই তদন্তের ক্ষমতা পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে পৃথক তদন্ত সংস্থাকে দিলে দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত হবে। এতে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমবে, প্রকৃত আসামিদের সাজা হবে, নির্দোষ মানুষ ফাঁসবে না এবং তদন্তে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হবে।
সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের বিষয়ে মন্তব্য জানতে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। মন্তব্য জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চাকরিতে থেকে সরকারি কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে কেউ মতামত দিতে পারেন না। এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ১১ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ জমা দেয়। ওই সুপারিশে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী আইনজীবী নিয়োগ দিতে পৃথক অ্যাটর্নি সার্ভিস করার প্রস্তাবও রয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশে বিরোধী পক্ষকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা এবং পুলিশকে ব্যবহারের মাধ্যমে হেনস্তার ঘটনা অহরহ ঘটে। এর ওপর রয়েছে পুলিশের কিছুসংখ্যক সদস্যের দুর্নীতি; যা রোধের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, তদন্ত সংস্থায় নিয়োজিত জনবল পুলিশ বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাদের নিয়োগ, চাকরির শর্তাবলি, নিয়ন্ত্রণ, বাজেট, অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয় একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোভুক্ত হবে। মামলা হওয়ার পরই কেবল তদন্ত সংস্থা কাজ শুরু করবে। তবে জরুরি ক্ষেত্রে এবং ঘটনার জটিলতা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে পুলিশ আনুষ্ঠানিক মামলা করার আগেও সম্ভাব্য তদন্তের অংশ হিসেবে তদন্ত সংস্থার সহায়তা নিতে পারবে। তদন্ত শুরুর প্রথম পর্যায় থেকেই তদন্তকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি বা প্রসিকিউটরের তদারকিতে তদন্তকাজ চালাবেন। পুলিশ বিভাগ ও তদন্ত সংস্থার কাজের সুনির্দিষ্ট বিভাজন থাকবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন এবং যথাযথ বিধানসংবলিত নতুন আইন তৈরি করতে হবে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন বলেন, পুলিশ এখন প্রভাবের কারণে, অন্যান্য পেশাগত দায়িত্বে বেশি ব্যস্ততার কারণে ঠিকঠাক তদন্ত করতে পারে না। ফৌজদারি মামলার গতিপ্রকৃতি ও ফলাফল প্রাথমিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভরশীল। তদন্ত কর্মকর্তা সৎ, সাহসী, দক্ষ ও পেশাদার না হলে তদন্ত প্রতিবেদনে নানা দুর্বলতা থেকে যায়। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তো অনেক পুরোনো। এতে প্রকৃত আসামি পার পেতে পারেন, নির্দোষ ব্যক্তি ফেঁসে যেতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়েও তদন্ত শেষ হয় না। তদন্তে সমস্যার কারণে আসামি সুবিধা পান। তিনি বলেন, পৃথক তদন্ত সংস্থা হলে তারা প্রসিকিউশন সার্ভিসের সঙ্গে মিলে তদন্ত করবে। এতে তদন্তের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পেশাগত দক্ষতাও বাড়বে।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মামলার তদন্তকাজ চলাকালে সরকারি প্রসিকিউটরের তদন্ত তদারকির সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সমন্বয়ের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই আদালতে মামলার বিচারকাজ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যান। প্রচলিত তদন্তব্যবস্থা এবং তাতে নিয়োজিত জনবলকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে বিচারব্যবস্থায় তদন্তপ্রক্রিয়ার যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র, কার্যকর, দক্ষ, নির্ভরযোগ্য, জনবান্ধব এবং প্রভাবমুক্ত তদন্ত সংস্থা গঠন প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, এটি খুব যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে, তাদেরই তদন্তের দায়িত্ব দিলে মামলা প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ থাকে। এ জন্য তারা স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থার কথা বিভিন্ন সময় বলেছেন। তিনি বলেন, শুধু স্বতন্ত্র সংস্থা করলেই হবে না; সততা, যোগ্যতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সংস্থার কেউ প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় নয়, ফৌজদারি অপরাধও আমলে নিতে হবে। সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে ওই তদন্ত কর্মকর্তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এটি হলে বিচারও দ্রুত হবে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা বিচারপ্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা বাড়াবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ থেকে তদন্তকারী সংস্থাকে আলাদা করলে তদন্তপ্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের অবহেলা ও অসদাচরণ কমবে।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, এ পর্যন্ত বড় যত মামলা ছিল, সব কটিতে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে। এভাবে হস্তক্ষেপ করলে কোনো প্রতিষ্ঠানই সঠিকভাবে তদন্ত করতে পারবে না। তিনি বলেন, সুপারিশ অনুযায়ী তদন্ত সংস্থা স্বতন্ত্র অ্যাটর্নি সার্ভিসের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবে বলে এটি রাজনৈতিক ও অন্যান্য অপেশাগত প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্ত করতে পারবে। এতে মিথ্যা, হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। দ্রুত তদন্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতেও সাহায্য করবে।
তানিম হোসেইন শাওন বলেন, সব দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা থাকে, তারা তদন্ত করে না। তদন্তের জন্য পৃথক সংস্থা থাকে। বিভিন্ন মহল এমনকি পুলিশের যারা সঠিকভাবে তদন্ত করতে চান, তাদেরও দাবি ছিল পৃথক সংস্থার।
এম.কে
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪