TV3 BANGLA
আন্তর্জাতিক

প্রাণীদের মল দিয়ে বিপন্ন প্রজাতি রক্ষার সম্ভাবনাঃ গবেষণা

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণীদের মলের মধ্যে কিছু কোষ জীবিত থাকে, যা নির্দিষ্ট প্রজাতির জেনেটিক বৈচিত্র্য বাড়াতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

গবেষকরা জানিয়েছেন প্রাণীদের মল থেকে নতুন প্রাণী সৃষ্টি করা এক জাদুকরী কৌশল! কিন্তু গবেষকরা সফল হলে, এটি বাস্তবে রূপ নিতে পারে এবং বিপন্ন প্রাণীদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

তুষার চিতা থেকে শুরু করে সামুদ্রিক কচ্ছপ—বিশ্বজুড়ে বহু প্রাণী হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বন্যপ্রাণীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এতটাই মারাত্মক হয়েছে যে কিছু বিজ্ঞানী একে “জীববৈচিত্র্যের গণবিলুপ্তি” বলে অভিহিত করেছেন।

বর্তমানে গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখছেন, প্রাণীদের মল ব্যবহার করে তারা কীভাবে তাদের জেনেটিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে পারেন।

“পু জু” নামে পরিচিত এই প্রকল্পের মূল ধারণাটি সহজ—মল শুধু অপাচ্য খাদ্য, ব্যাকটেরিয়া ও পিত্তই ধারণ করে না, বরং প্রাণীর অন্ত্রের কোষও এতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি মলটি নতুন হয়, তবে এর কিছু কোষ জীবিত থাকতে পারে।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুজানাহ উইলিয়ামস বলেছেন, “গবেষণা এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ফলাফল আশাব্যঞ্জক।” গবেষকরা ইতোমধ্যে ইঁদুরের মল ও হাতির মল থেকে জীবিত কোষ আলাদা করেছেন।

এই গবেষণার মূল লক্ষ্য হলো, এই জীবিত কোষগুলো ব্যবহার করে বিপন্ন প্রাণীদের জেনেটিক বৈচিত্র্য বাড়ানো, যাতে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

এই পদ্ধতিকে “জেনেটিক রেসকিউ” বা জেনেটিক উদ্ধার বলা হয়, যা বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রথমত, এই কোষ থেকে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রজাতির জেনেটিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে পারবেন, যা সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে আরও কার্যকর করতে সাহায্য করবে।

তবে এর চেয়েও বড় সম্ভাবনা হলো, যদি মল থেকে সংগৃহীত কোষ ল্যাবে বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে উন্নত প্রজনন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুরো প্রাণীই তৈরি করা সম্ভব হতে পারে।

এর মধ্যে ক্লোনিং প্রযুক্তিও রয়েছে, যেখানে একটি কোষের নিউক্লিয়াস দাতা ডিম্বাণুর মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়, তারপর বিদ্যুৎ-সংকেত দিয়ে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়, যা একটি সারোগেট মা প্রাণীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। এর ফলে মূল প্রাণীর একটি জেনেটিক “যমজ” তৈরি হয়।

গবেষকরা আরও একটি আকর্ষণীয় সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন—কোষগুলোকে পুনরায় প্রোগ্রাম করে যেকোনো ধরনের কোষে রূপান্তর করার প্রযুক্তি। ইঁদুরের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, এই কোষগুলোকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুতে পরিণত করা সম্ভব। এর মানে, ভবিষ্যতে IVF বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে মল থেকে সংগৃহীত কোষের মাধ্যমে নতুন প্রাণী সৃষ্টি করা যেতে পারে।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জিন সম্পাদনা (gene-editing) করে বন্যপ্রাণীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারেন। এমনকি, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির পুনরুজ্জীবনেও এটি ব্যবহার করা হতে পারে, যেমন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা Revive & Restore ইতোমধ্যে বিলুপ্ত প্যাসেঞ্জার পায়রা ফিরিয়ে আনার জন্য জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

গবেষণায় দেখা গেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবিত কোষগুলোকে -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনে সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা অনির্দিষ্টকাল ধরে রাখা যাবে।

ইতোমধ্যে, Nature’s Safe এবং San Diego’s Frozen Zoo-এর মতো সংস্থাগুলো বিপন্ন প্রাণীদের শুক্রাণু, ডিম্বাণু ও ত্বকের কোষ সংরক্ষণ করছে। তবে এটি সাধারণত সরাসরি প্রাণীর দেহ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, যা অনেক সময় কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে, মল থেকে কোষ সংগ্রহ করা হলে এটি সম্পূর্ণভাবে অপ্রবেশযোগ্য (non-invasive) এবং সহজ হবে।

যদিও এই পদ্ধতিতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এটি এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিপুল পরিমাণ মল প্রক্রিয়াকরণ করা একটি বড় কাজ। গবেষকরা বলেন, “প্রথমে আমাদের বালতি ও চালনির মতো সরঞ্জাম দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে।”

এছাড়া, মলে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অনুজীব থাকে, যা থেকে প্রাণীর কোষ আলাদা করা কঠিন হতে পারে। গবেষকরা এর সমাধান হিসেবে ব্যাকটেরিয়া সরিয়ে ফেলার জন্য ডাইলিউশন (dilution) এবং অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন।

যদিও “পু জু” এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে, তবে গবেষকরা আশাবাদী। অধ্যাপক উইলিয়ামস ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় হোয়াইট গণ্ডার (Northern White Rhino) বাঁচাতে ল্যাব-ভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করছেন, আর Revive & Restore সফলভাবে ব্ল্যাক-ফুটেড ফেরেট (Black-Footed Ferret) নামক একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ক্লোনিং করেছে।

তবে, কিছু সংরক্ষণবিদ মনে করেন, বিলুপ্তির আগে প্রাণীদের রক্ষা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

WWF UK-এর প্রধান বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা পল ডি অর্নেলাস বলেছেন, “যতই নতুন প্রযুক্তি আসুক, আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রাণীদের বিলুপ্তির পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই রক্ষা করা।”

ক্লেমসন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণী গবেষক ড. ডেভিড জ্যাচোভস্কি বলেন, “শুধু নতুন প্রাণী তৈরি করলেই হবে না, বরং বন্য পরিবেশে তাদের টিকে থাকার জন্য হুমকিগুলো দূর করাও জরুরি।”

তবে “পু জু” প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা বলছেন, সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন একসঙ্গে চালানো সম্ভব।

গবেষক রিয়ানন বোল্টন বলেন, “আমি বলছি না যে আমাদের সংরক্ষণ প্রচেষ্টা বন্ধ করে দিতে হবে। তবে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে আমাদের একাধিক সমাধান নিয়ে কাজ করতে হবে।”

সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান

এম.কে
১৭ মার্চ ২০২৫

আরো পড়ুন

৩ হাজার কিলোমিটার হেঁটে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ নাগরিক

নাইজারে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল

ধ্বংসের দোরগোড়ায় আরও এক মার্কিন ব্যাংক