নিম্নমানের বিটুমিন দিয়ে সড়ক নির্মাণ ও এ খাতে জড়িতদের বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানি রিপোর্ট আসছে গণমাধ্যমে। এরই মাঝে খবর মিলল, সড়ক নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিটুমিন আমদানির আড়ালে বিগত ১০ বছরে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ‘ওভার ইনভয়েসিং’ বা আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচারের পাশাপাশি দেশ হারাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংকের রিজার্ভ।
সোমবার (২৪ মে) বাংলানিউজের এ ধারাহিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিটুমিন আমদানির আড়ালে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের মতো বিষয়ে তদন্ত করে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪ থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড দেশে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিটুমিন উৎপাদন করে যা চাহিদার মাত্র ১৩ শতাংশের মতো। অর্থ্যাৎ বাকি অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার বিটুমিনের প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে।
বিটুমিন আমদানিকারকদের একটি অংশ এসব বিটুমিনকে উন্নত মানের ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন বললেও অনুসন্ধানে দেখা যায় ভিন্ন তথ্য। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় এসব বিটুমিনের কোনো কোনোটির গ্রেড পাওয়া গেছে ১০২, কোনোটির ৯৫, আবার কোনোটির ৯৮। বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে আলকাতরার চেয়েও নিম্নমানের বলে দাবি করছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করে দেখা গেছে, ৮০ থেকে ১০০ গ্রেড মানের বিটুমিনের বাজারমূল্য টনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৮০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। গড়ে ১৬০ ডলার বা ১৩ হাজার ৬০০ টাকা দর বিবেচনায় ৯ মাসে আমদানি করা বিটুমিনের প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় ৪৩৪ কোটি ৭৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা। অথচ ৯ মাসে আমদানিকারকরা বিদেশে পাঠিয়েছেন প্রায় এক হাজার ৫২২ কোটি টাকা।
এনবিআরের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে খালাস করা বিটুমিনের টনপ্রতি মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে গড়ে ৫৬০ ডলার বা ৪৭ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন বিটুমিনের বিপরীতে বিদেশে পাঠানো হয় বাড়তি ৩৪ হাজার টাকা। ফলে বিটুমিনের প্রকৃত মূল্যের বাইরে বাড়তি প্রায় এক হাজার ৮৭ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতিবছর গড়ে চার লাখ ২০ হাজার টন বিটুমিন আমদানি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ হিসাবে প্রকৃত মূল্যের বাইরে প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে অন্তত এক হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ১০ বছরে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২৮০ কোটিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অংক পাচার হওয়ার অংকের ন্যূনতম সংখ্যা। অধিকতর যাচাইবাছাই করা হলে প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরও আকার ধারণ করবে।
বিটুমিন আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানে না বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে এ বিষয়ে তদন্ত করার আশ্বাস পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ৪২টি প্রতিষ্ঠান ৩৪৬টি চালানে বিটুমিন আমদানি করেছে।
বিটুমিনের চাহিদার তুলনায় দেশীয় উৎপাদন কম হওয়ায় যে ঘাটতি দেখা দেয়, তার সুযোগে দেশে গড়ে উঠেছে আমদানিকারকদের একটি শক্তিশালী চক্র। অর্থপাচারের কৌশল জিইয়ে রাখতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনাকেও পাত্তা দিচ্ছে না সংঘবদ্ধ চক্রটি। ফলে আমদানি করা মানহীন ও ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার একটুও কমেনি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আর বলছেন, মানহীন বিটুমিন ব্যবহারের কারণে সড়ক মেরামত ব্যয় গত এক দশকে অন্তত চার গুণ বেড়েছে। আমদানি করা ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার ঠেকাতে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। তবু এটি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার বন্ধে বড় বাধা আমদানিকারকদের একটি সিন্ডিকেট। তারা কম দামে নিম্নমানের বিটুমিন এনে অনুমোদন ছাড়াই নানা কৌশলে খালাস করছে। একদিকে অর্থপাচার হচ্ছে, অন্যদিকে নিম্নমানের ভেজাল বিটুমিনে ক্ষতির মুখে সড়ক-মহাসড়ক। এতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে সরকার। গুটিকয়েক আমদানিকারকের লোভের মাসুল দিচ্ছে দেশের মানুষও।
২৪ মে ২০২১
নিউজ ডেস্ক