যুক্তরাজ্যের ভাসমান আশ্রয়কেন্দ্র বিবি স্টকহোমে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে ‘গবাদি পশু’-এর মতো আচরণ করা হয়৷ দেয়া হয় খারাপ খাবার৷ তারা ছারপোকার আক্রমণের পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতিরও শিকার হয়েছেন৷ তাদের অবস্থাটা যেন, ‘জলে ভাসা শ্যাওলার’ মতো৷ ভাসমান ওই আশ্রয়কেন্দ্রের সাবেক কর্মীরাই এমন কথা জানিয়েছেন৷
শুরু থেকেই ডরসেটে স্থাপিত বিবি স্টকহোম নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে ব্রিটিশ সরকার৷ এক আশ্রয়প্রার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় সেই বিতর্ক আরো তীব্র হয়ে উঠে৷
কিন্তু এই প্রথমবারের মতো বার্জটির অপ্রীতিকর অবস্থা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন সাবেক দুই কর্মী৷
২০২৩ সালের গ্রীষ্ম থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত ভাসমান আশ্রয়কেন্দ্রটিতে কর্মরত ছিলেন লেভানা কোকার এবং বেলা বাসস্টোন৷ কোকার কাজ করতেন গৃহকর্মী হিসাবে৷ আর বাসস্টোন অভ্যর্থনার কাজে যুক্ত ছিলেন৷
তারা জানিয়েছেন, বার্জের কর্মীদের আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করতে দেখেছেন তারা৷ আশ্রয়প্রার্থীদের কোনো অভিযোগ আমলে নেয়া হতো না বলেও জানান তারা৷
কোকার বলেন, ২৭ বছর বয়সি লিওনার্ড ফারুকুর আত্মহত্যার পর বার্জে থাকা অনেক আশ্রয়প্রার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন৷
কোকার আরো বলেন, “বার্জে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে গবাদি পশু বা চিড়িয়াখানার পশুদের মতো আচরণ করা হতো৷ এটা বন্ধ করে দেয়া উচিত৷’’
ফারুকুকে চিনতেন বাসস্টোনও৷ তিনি বলেন, ‘‘তিনি যখন বার্জে এসেছিলেন তখন বেশ হাসিখুশি ছিলেন৷ খুবই মজার এবং মিষ্টি মানুষ ছিলেন, কিন্তু তারপর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিলেন৷’’
বাসস্টোন আরো বলেন, ‘‘তার মৃত্যুর পর আমাদের বলা হয়েছিল, এ কথা যেন আমরা কাউকে না বলি৷’’
কোকার বলেন, একবার বার্জে থাকা একজন আশ্রয়প্রার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং খাবার পেটে রাখতে পারছিলেন না৷ তখন চিকিৎসক তাকে বরফশীতল পানীয় পান করানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন৷
তখন কোকার তার বাড়ি গিয়ে তার বরফশীতল পানীয় তৈরির অনুমতি চেয়েছিলেন৷ কিন্তু বার্জের এক কর্মী তাকে সেই অনুমতি দেননি৷ উল্টো ওই কর্মী রাগতস্বরে কোকারকে বলেছিলেন, ‘‘এটি আপনার কাজ নয়৷ তার মৃত্যুতে আমার কিছু যায় আসে না৷’’
বার্জে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি কেউ সহানুভূতিশীল ছিলেন না, এ কথা জানিয়ে কোকার বলেন, ‘‘বার্জের কর্মীরা আশ্রয়প্রার্থীদের জলে ভাসা শ্যাওলা ভাবতেন৷ আশ্রয়প্রার্থীদের বার্জ থেকে বেরোনোর অনুমতি ছিল না৷ এটা অনেকটা কারাগারের মতো ছিল৷’’
আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডা পাঠানো হুমকি দেয়া হতো বলেও জানিয়েছেন ওই দুই কর্মী৷ তারা বলেন, ‘‘এসব কারণে আশ্রয়প্রার্থীদের সবার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছিল৷’’
বাসস্টোন বলেন, আমি একজন দেখেছিলাম বার্জে আসার সময় তিনি ‘খুব হাসিখুশি’ ছিলেন৷ কিন্তু ‘‘এক সপ্তাহ পরে আমি তাকে সিঁড়িতে বসে কাঁদতে দেখেছি, দেখেছি সমুদ্রের দিকে উদাসীনভাবে তাকিয়ে আছেন৷’’
বাসস্টোন আরো বলেন, ‘‘বার্জে আসা পুরুষেরা নানা কিছু নিয়ে ভীত ছিলেন৷ সেখানে এলেই তারা জানতে চাইতেন, তাদের রুয়ান্ডায় পাঠানো হবে কিনা৷’’
তিনি আরো জানান, ‘‘কখনও কখনও বার্জের রুম পানিতে প্লাবিত হয় এবং অনেকেই ভয় পেতেন৷ মনে করতেন বার্জটি বুঝি ডুবে যাচ্ছে৷ ফলে, তেমন পরিবেশে কেউ নিজেদের নিরাপদ মনে করতেন না৷’’
বাজে খাবার, ছারপোকা, পানি উঠার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বার বার অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পেতেন না আশ্রয়প্রার্থীরা৷ কোকার বলেন, আশ্রয়প্রার্থীদের ১০টি অভিযোগের নয়টিকেই কোনো গুরুত্ব দেয়া হতো না৷
তিনি বলেন, ‘‘যখনই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বা এমপিরা বার্জটিতে আসতেন তখন সেটি খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়৷ স্বাভাবিকের চেয়ে ভালো খাবার দেয়া হয়৷ বার্জ খোলার আগে যখন সাংবাদিকেরা এসেছিলেন, তখন তাদের বাছাই করা কয়েকটি কক্ষ দেখানো হয়েছিল৷’’
বার্জের কর্মী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছিল৷ সেই গ্রুপের কিছু বার্তা দেখেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান৷ সেখানে এক আশ্রয়প্রার্থী লিখেছেন, তিনি যেখানে আছেন সেখানে বিদ্যুৎ নেই, তাই গরম পানি পাওয়া যাচ্ছে না৷
একজন আশ্রয়প্রার্থী গ্রুপে লিখেছেন, ‘‘এই বার্জটিকে জেলখানার মতো মনে হচ্ছে৷’’
অন্য একজন অভিযোগ করে লিখেছেন, ‘‘মাছটি এমনভাবে রান্না করা হয়েছিল যে, আমার সঙ্গে কথা বলছিল৷’’
অপর এক আশ্রয়প্রার্থী লিখেছেন, মাংস যা শক্ত, চিবাতে গিয়ে তার কিছু দাঁত হারিয়ে গেছে৷
একজন আশ্রয়প্রার্থী একটি গেম রুম খোলার অনুরোধ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘আমরা সবাই হতাশার ঘরে আছি৷’’
বার্জের সাবেক দুই কর্মীর এমন সব অভিযোগ মানতে নারাজ ব্রিটিশ হোম অফিস বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ তারা জানিয়েছে, ‘‘আমরা এই ধরনের কোনো অভিযোগই মানছি না৷ আমাদের আওতায় থাকা প্রত্যেকের সঙ্গে মর্যাদা এবং সম্মানের সঙ্গে আচরণ করা হয়৷’’
বার্জটি ইউএনএইচসিআরসহ বেশ কয়েকটি সংসদীয় কমিটিও পরিদর্শন করেছে বলেও জানিয়েছে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
হোম অফিস আরো জানিয়েছে, ‘‘বার্জে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তাসহ স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে৷ এসব সেবার মান নিয়ে কোনো অভিযোগ এলে, আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তা দ্রুত সমাধান করি৷ এছাড়াও মাইগ্রেন্ট হেল্প ২৪/৭ বা অভিবাসী সহায়তার সুযোগ সাত দিনে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে৷’’
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
১৭ মে ২০২৪