ওয়েলসের কাইয়ারফিলি উপনির্বাচনে প্লেইড কামরি (Plaid Cymru)-র দাপুটে জয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চমকে দিয়েছে। উপনির্বাচনে দলটি পেয়েছে ৪৭.৪ শতাংশ ভোট, যা ২০২১ সালের নির্বাচনের চেয়ে ১৯ পয়েন্ট বেশি। এই ফলাফল শুধু প্লেইড কামরির জন্য নয়, নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন রিফর্ম ইউকের জন্যও বড় ধাক্কা, কারণ এই ভোটে দেখা গেছে—বিরোধী দলগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা রিফর্মের উত্থান ঠেকাতে কার্যকর হচ্ছে।
১৯১৮ সাল থেকে কাইয়ারফিলি আসনটি ধরে রাখা লেবার পার্টি এবার ভরাডুবির শিকার হয়েছে। তাদের ভোট কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ শতাংশে, যা ওয়েলসের ইতিহাসে লেবারের সবচেয়ে বড় উপনির্বাচনী পতন। অন্যদিকে, কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে মাত্র ২ শতাংশ ভোট, যা দলের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। এই ফলাফল ওয়েলসজুড়ে লেবারের প্রতি ক্রমবর্ধমান হতাশা ও রাজনৈতিক ক্লান্তির ইঙ্গিত দেয়।
রিফর্ম ইউকে পেয়েছে ৩৬ শতাংশ ভোট, যা জাতীয় পর্যায়ের তাদের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে জয় থেকে তারা অনেক দূরে ছিল, কারণ কৌশলগত ভোটের ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রগতিশীল দলগুলো তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রিফর্মের সমর্থন মূলত ব্রেক্সিটপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী ভোটারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা দলটির জাতীয় বিস্তারে বড় সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে।
বিজয়ী প্রার্থী লিন্ডসে হুইটল, যিনি ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৪তমবারের মতো এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণে ব্যাপক ভোট পেয়েছেন। এই জয় রুন আপ ইয়োরওয়ার্থ-এর নেতৃত্বে প্লেইড কামরি-কে ওয়েলসের আগামী ফার্স্ট মিনিস্টার হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে দিয়েছে। নতুন আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় তারা সম্ভবত সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওয়েলসে দীর্ঘ ২৬ বছরের ক্ষমতার ক্লান্তি, স্বাস্থ্যসেবায় সংকট, এবং স্যার কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যজুড়ে লেবারের অজনপ্রিয়তা—সব মিলিয়ে দলটির প্রতি ভোটার আস্থা কমছে। ২০২৪ সালে ওয়েলসে তাদের সমর্থন কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশে, যা গর্ডন ব্রাউনের সময়কার সমান। দেশজুড়ে জরিপে লেবারের অবস্থান এখন ২০–২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, যা ২০২৬ সালের নির্বাচনে তাদের তৃতীয় স্থানে নামিয়ে দিতে পারে।
স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যার জন কার্টিস দ্য টাইমস-এ বিশ্লেষণ করে বলেছেন, কাইয়ারফিলির ফলাফল প্রমাণ করেছে—‘ট্যাকটিকাল ভোটিং’ বা কৌশলগত ভোটদান এখন ফারাজের সবচেয়ে বড় বাধা। ভোটাররা তাদের দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিয়েছেন, যাতে রিফর্ম জয়ী না হতে পারে। তিনি একে বলছেন, “প্রথমে পৌঁছানো প্রার্থীই জয়ী হয় এমন ভোটব্যবস্থায় (FPTP) এটি এক শক্তিশালী অস্ত্র।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই ধারা যদি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, তবে ২০২৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে রিফর্ম ইউকে-র সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের ভোট ছড়িয়ে থাকলেও, লেবার, লিবারেল ডেমোক্র্যাট, গ্রিন, প্লেইড ও এসএনপি একত্রে কাজ করলে বামঘেঁষা ভোটের ৪০–৫০% একত্রিত হয়ে ফারাজকে ৩২৬ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেইন গ্রিন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে অ্যান্টি-টোরি কৌশলগত ভোটের কারণে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা মাত্র ৫% ভোট নিয়েও ৭২টি আসন পায়। অপর এক গবেষক ড. স্টিফেন ফিশার দেখিয়েছেন, লেবার ও লিবারেল ডেমোক্র্যাট ভোটারদের পারস্পরিক সমর্থন বেড়েছে, কিন্তু কনজারভেটিভ ও রিফর্ম ভোটারদের মধ্যে সম্পর্ক কমছে—যা ফারাজবিরোধী ঐক্যকে আরও জোরদার করবে।
কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টিম বেল মন্তব্য করেছেন, “নাইজেল ফারাজের বিভাজনমূলক ভাবমূর্তি এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাব রিফর্মকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই দল হতে দিচ্ছে না।”
অন্যদিকে, দ্য টেলিগ্রাফের সহযোগী সম্পাদক পপি কবর্ন বলেছেন, “যদি লেবার, লিবারেল ডেমোক্র্যাট, গ্রিন, প্লেইড ও এসএনপি যৌথভাবে ফারাজবিরোধী কৌশল নেয়, তাহলে এটা রিফর্ম পার্টির জন্য ভয়াবহ খবর।”
সূত্রঃ ডেইলি এক্সপ্রেস
এম.কে

