আমাদের জাতির অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য ছিল ‘সামাজিক পুঁজি’। কিন্তু এটি ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, এবং রাষ্ট্র আমাদের অপরাধ থেকে রক্ষা করতেও হিমশিম খাচ্ছে।
ব্রিটেনকে ভালোবাসতে শেখার পেছনে ছিল ছোট ছোট কিছু বিষয়। দোকানে গিয়ে টাকা গুনে নিতে হতো না। রাস্তায় প্রাইভেট নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখা মিলত না। কল থেকে পানি খাওয়া যেত। সুইচ টিপলেই আলো জ্বলে উঠত।
ট্যাক্সিতে উঠলে নিশ্চিত থাকা যেত—মার খেতে হবে না, চালক সংক্ষিপ্ত পথেই নিয়ে যাবে এবং সঠিক ভাড়া নেবে। লাল বাতিতে গাড়ি থামালে পেছনের গাড়িগুলো রেগে হর্ণ বাজাত না। পোস্টে মূল্যবান জিনিসপত্র পাঠানো যেত নির্ভরতার সঙ্গে।
মাত্র সাত বছর বয়সে পেরু থেকে ব্রিটেনে এসে আমি এইসব বিষয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই, এবং আজও সেই মুগ্ধতা পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। তখন যেমন মনে হতো, আজও মনে হয়—এই দেশে জন্ম নেওয়া মানুষজন খুবই উদাসীন এই বিশেষত্বগুলো নিয়ে।
অনেক পরে আমি এই পার্থক্য বোঝাতে একটি শব্দ খুঁজে পাই: “সামাজিক পুঁজি (social capital)।” ব্রিটেন ছিল একটি উচ্চ-আস্থার সমাজ—যেখানে দৈনন্দিন লেনদেন ছিল ঝামেলাহীন। ব্যবসা পরিচালনার খরচ কম ছিল, কারণ প্রতারণা ঠেকাতে কেউ অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করত না। এই সামাজিক পুঁজি ব্রিটিশদের মধ্যে দেশপ্রেম এবং দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করত। তারা নির্বাচনে হারলেও ফল মেনে নিত, অপছন্দের আইন মেনেও চলত, ট্যাক্স দিত বিরক্তি নিয়ে হলেও সততার সঙ্গে।
এটাই ছিল ব্রিটেনের বিশেষত্ব—যা ১৯শ ও ২০শ শতাব্দীতে বিদেশিদের চোখে বিস্ময় জাগাতো। কিন্তু এখন সেই সামাজিক পুঁজি ধ্বংস হচ্ছে।
অনেকভাবেই তা চোখে পড়ে। যেমন চুরি-ডাকাতির ভয়াবহতা—গত বছর দোকানগুলোতে চুরির সংখ্যা ছিল ২.০৪ কোটি, যা আগের বছরের চেয়ে ৩.৭ মিলিয়ন বেশি। আবার লন্ডনের রাস্তাঘাটও আগের মতো পরিষ্কার নেই। পর্যটকদের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলো এখনো ময়লা পরিষ্কার করে, কিন্তু বাকি শহরজুড়ে যেন অস্থায়ী ডাস্টবিন—খালি খাবারের বাক্স আর মোড়কের রাজত্ব।
সরকারের প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায়, সিঙ্গেল-ইউজ ভেপ নিষিদ্ধ করা নিয়ে সরকার খুব উদ্যোগী। যদিও ভেপ থেকে কিছুটা আবর্জনা হয়, কিন্তু আসল সমস্যাটা কি সেটা সরকার চিহ্নিত করতেই পারছে না। যার অর্থ দাঁড়ায় মূল সমস্যা এড়িয়ে রাজনীতিবিদদের গৌণ ইস্যুতে দৃষ্টি দেওয়া—যেমন ম্যানচেস্টার এরিনার বোমা হামলার পর সীমান্ত নীতির ঘাটতি নিয়ে কিছু না করে ছোট ছোট ভেন্যুর কর্মীদের ‘অ্যান্টি-টেরর ট্রেনিং’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
সমস্যা ভেপ নয়, সমস্যা হলো মানুষ আর পরোয়া করে না তার শহরের চেহারা কেমন দেখাচ্ছে। কেন এই পরিবর্তন—বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে—তা আমাদের ভাবা উচিত।
কি এটা বিদেশ থেকে এমন জনসংখ্যা আসার ফল, যারা রাস্তায় ময়লা ফেলার বিষয়টিকে স্বাভাবিক ভাবে? নাকি বাড়ি থেকে কাজ বা ভুয়া ইনভ্যালিডিটি সুবিধা নেওয়ার কারণে মানুষের কর্মস্থলে না থাকাটা দায়ী? নাকি লকডাউন নিজেই দায়ী—মানুষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে, কনস্পিরেসি থিওরি স্ক্রল করতে করতে কি তারা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে?
এই একই প্রশ্ন আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত দোকান থেকে চুরির ক্ষেত্রেও, যার ফলে রিটেইল ব্যবসা বছরে £২ বিলিয়ন ক্ষতির মুখে পড়ছে—এবং শেষমেশ এর খেসারত দিচ্ছে সৎ ক্রেতারা। আগে মানুষ চুরি করত না শুধুমাত্র আইনি শাস্তির ভয় থেকে নয়, বরং কারণ তারা জানত এটি অসঙ্গতিপূর্ণ, অন্যায়। এই অনুভূতিটাই কোভিডের সময় ধ্বংস হয়েছে। একই সময়ে অতিরিক্ত ইমিগ্রেশন সমাজে একরকম ঐক্যের অভাব তৈরি করেছে—যা উচ্চ-আস্থা সম্পন্ন সমাজের জন্য অত্যাবশ্যক।
একটি দেশের চারিত্রিক পরিবর্তন প্রথমে দেখা যায় আইন প্রয়োগে, আইনের ভাষায় নয়। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের দেশে এখনো চুরিবিরোধী আইন আছে। কিন্তু বাস্তবে পুলিশ এখন আইনভঙ্গকারীদের চেয়ে অপ্রচলিত মত প্রকাশকারীদের ধরতে বেশি উৎসাহী।
একজন নারীর উদাহরণ ধরা যাক—লুসি কনলি। তাকে অনলাইনে কিছু ‘চড়া’ পোস্ট দেওয়ার জন্য জেলে পাঠানো হয়। অথচ সে যদি বারবার দোকান থেকে চুরি করত, তাও এই শাস্তি পেত না। পুলিশ এখন আর “ইউনিফর্ম পরা নাগরিক” নয়, বরং রাষ্ট্রীয় মতবাদ রক্ষার কর্মকর্তা হয়ে উঠেছে।
এই অবস্থায় সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব চলে যাচ্ছে নাগরিকদের হাতে। এবং এখানেই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে—আমরা এক নিম্ন-আস্থা সম্পন্ন সমাজে পরিণত হচ্ছি, অনেকটা লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার গরিব দেশগুলোর মতো।
ধনীরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য গেটেড কমিউনিটিতে চলে যাচ্ছে, প্রাইভেট সিকিউরিটি নিয়োগ দিচ্ছে, সেনট্রি পোস্ট বসাচ্ছে—বিশেষ করে সিনাগগগুলোর বাইরে, যেগুলো এখন পুলিশ কর্তৃক সুরক্ষিত মনে করে না। পার্লামেন্টের চারপাশে নতুন এক বিশ্রী প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছে।
আমার শহর লিমায়, বড় ঘরবাড়িতে সবসময় ইউনিফর্ম পরা নিরাপত্তা রক্ষী থাকত—যাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হত “guachimán” (স্প্যানিশে ইংরেজি ‘watchman’ এর ব্যাকরণগত রূপ)। লন্ডন কবে এই পথে হাঁটবে?
যাদের নিজের গুয়াচিমান ভাড়া করার সামর্থ্য নেই, তাদের জন্য আছে নিজ হাতে নিরাপত্তা রক্ষা। যেমন, এক দম্পতির গাড়ি চুরি যাওয়ার পর তারা এয়ারট্যাগ দিয়ে লোকেশন খুঁজে নিজেরা গিয়ে গাড়ি উদ্ধার করেছে। পুলিশের ভূমিকা? নিষ্ক্রিয়।
এখন নাগরিকরাই ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ফাঁকগুলো পূরণ করছে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় টিউব ট্রেন থেকে গ্রাফিটি পরিষ্কার করছে—যার জবাবে মেট্রো কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা হয়তো ভুল ক্লিনার ব্যবহার করছে!
আর রবার্ট জেনরিক, ছায়া বিচারমন্ত্রী, নিজ হাতে মেট্রোতে ফেয়ার ফাঁকি দেওয়া যাত্রীদের ধাওয়া করেছেন। মেট্রো কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, তিনি তাদের অনুমতি না নিয়েই ভিডিও করেছেন—কারণ তারা নিজেদের অযোগ্যতা ধরা পড়েছে বুঝে গেছে।
আমি বিশ্বাস করি, অনেক কিছু যা রাষ্ট্র খারাপভাবে করে, তা ব্যক্তিরা অনেক ভালোভাবে করতে পারে। কিন্তু এখনকার ব্রিটেন কোনোভাবেই লিবার্টারিয়ান সমাজ নয়। ট্যাক্স এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সর্বোচ্চ, জাতীয় ঋণ তিন গুণ, আর প্রতিদিন নতুন নতুন ছোটখাটো আইন পাস হচ্ছে—যেমন ফুটবল ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে, অফিসে কে কি কথা শুনবে তাও নিয়ন্ত্রণ করা।
এখানেই আমরা সত্যিকার অর্থে এক “উন্নয়নশীল দেশের” রূপ ধারণ করছি। একটি সরকার যা তার প্রধান দায়িত্ব—যেমন ন্যায়বিচার ও সম্পত্তি রক্ষা—পালনে ব্যর্থ, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করছে।
একসময় কি আমরা শুধু ‘টিকিট ফাঁকি দেওয়া’ প্রতিরোধ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সত্যিকারের বিদ্রোহী আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া শুরু করব? যেমন, ইসলিংটনে এক দোকানে চুরি এত বেড়ে গিয়েছিল যে, সব জিনিস—এমনকি খাবারও—অ্যান্টি-থেফট লকের ভেতর রাখা শুরু হয়। দোকানের সিকিউরিটি দুইবার মার খেয়েছে।
এই ঘটনা জানাজানি হতেই স্থানীয়রা একটি ক্রিকেট ব্যাট হাতে পাহারার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু, এটা তো ইসলিংটন—যেখানে আইনজীবীর অভাব নেই। তাদের কেউ কেউ সতর্ক করে দেন—এই স্বেচ্ছাসেবক পাহারাদাররাই শেষমেশ জেলে যাবে।
কি ভয়াবহ পতন! একসময় লি কুয়ান ইউ বলেছিলেন, কেমব্রিজে পড়ার সময় তিনি পিকাডিলি সার্কাসে গিয়ে দেখেছেন, মানুষ নিজে থেকে পত্রিকার মূল্য দিয়ে যাচ্ছে—একটি খোলা বাক্সে। কেউ চুরি করছে না।
এখন পিকাডিলি সার্কাসে এমন কিছুর কথা ভাবাও যায় না। বরং, এই ধরনের আচরণ এখন সিঙ্গাপুরে দেখা যায়—যেখানে বিশাল ইমিগ্রেন্ট জনসংখ্যাকেও জাতীয় ঐক্যের অনুভূতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ব্রিটেনে, এরিক কফম্যান যে “অসম বহুসংস্কৃতিবাদ” বলেছিলেন—অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের উদযাপন করা, আর সংখ্যাগরিষ্ঠদের হেয় করা—তার ফলেই, আমাদের সমাজে আস্থা আজ বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে।
আমরা ধীরে ধীরে “থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি” হয়ে যাচ্ছি। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়—আমরা যেন তাতে মোটেও পরোয়া করছি না।
সূত্রঃ দ্য টেলিগ্রাফ
লেখকঃ ড্যানিয়েল হ্যানান
অনুবাদঃ এম.কে
১৬ জুন ২০২৫