বিদেশে যেই চাকরির কথা বলে নেওয়া হয়েছে, সেই চাকরি দেওয়া হয়নি, যেই বেতনের কথা বলা হয়েছে, সেই বেতনও দেওয়া হয়নি। উল্টো বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিকদের দিয়ে করানো হয়েছে অতিরিক্ত কাজ, চলেছে অমানসিক নির্যাতন। মধ্যপ্রাচ্য ফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা যায় তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা।
বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এবং মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) আয়োজিত ‘মজুরি চুরি বিষয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের গণসাক্ষ্য’-বিষয়ক অনুষ্ঠানে বিদেশ ফেরত শ্রমিক ও আলোচকেরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সৌদি আরব, দুবাই, লেবানন থেকে করোনাকাল ও এর আগে ফিরে আসা ১২ জন শ্রমিক তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
প্রবাসী শ্রমিকেরা বলেন, শর্ত অনুযায়ী তাঁরা ছুটি পান না। আলোচনা ছাড়াই যখন-তখন বেতন কমানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিমা, চিকিৎসা, পরিবহন খরচ ও দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণের অজুহাতে শ্রমিকদের বেতনের টাকা কেটে রাখছেন মালিকেরা। যা পরবর্তীতে আর ফেরত পাচ্ছেন না তাঁরা। চাকরি, মজুরি ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের যেসব শর্ত রয়েছে, তার অধিকাংশই মানা হচ্ছে না। আর এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের মজুরি চুরির ঘটনা ঘটছে।
প্রবাসী শ্রমিকেরা বিদেশে গিয়েও শারীরিক নির্যাতন, না খেয়ে দিন কাটানো, ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১৮-১৯ ঘণ্টা কাজ করা, মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে টিকিট কেটে ফিরে আসার রোমহর্ষক বর্ণনা জানান।
এ রকম শ্রমিকদের একজন কুমিল্লা এলাকার বাসিন্দা এক নারী শ্রমিক। তাঁকে মেডিকেল ভিসার কথা বলে কুমিল্লা ওভারজিসের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল । দেড় লাখ টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে গৃহিণীর। তিন মাস কাজ করে কোনো বেতন পাননি।
ওই নারী শ্রমিক বলেন, ‘খাবার তো দূরের কথা, তাঁরা (সৌদি মালিক) আমাকে ঘুমাতে দিতেন না। আট ঘণ্টা কাজের কথা বলে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত আমাকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন।’ তাঁকে সেখানে নির্যাতন করা হতো। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টে দেশে ফিরে এসে কুমিল্লা ওভারসিজের মালিকের বিরুদ্ধে বিএমইটিতে অভিযোগ করেছিলাম। ক্ষতিপূরণ বাবদ মালিক মাত্র ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে। বাকি টাকা আজও ফেরত পাইনি।’
একই রকমের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আরেক নারী শ্রমিক। কুমিল্লার এই নারী ২৫ হাজার টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে এক মাস কাজ করেছিলেন। দিনে মাত্র দুটি রুটি খাবার দেওয়া হতো তাঁকে। এক মাস কাজ করার পর কোনো বেতন না দিয়ে দালাল চক্রের সদস্যেরা তাঁকে আটক করে একটি কক্ষে রাখেন।
তাঁকে সেখানে নির্যাতন করা হয়। সেখান থেকে পরিবারের কাছে ফোন করিয়ে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে বাসা থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে বিমানের টিকিট কেটে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে একজন শ্রমিককে দিয়ে ৮ ঘণ্টার বদলে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হচ্ছে, এটা মজুরি দাসত্ব। এসব অভিবাসী শ্রমিকেরা চারটি পর্যায়ে অবিচার, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
‘শ্রমিকেরা যখন বিদেশ যাচ্ছেন তখন যাওয়ার খরচ নিয়ে প্রতারণা হচ্ছে। এখানেই অবিচারের শুরু। এরপর মজুরি চুরি হচ্ছে। অর্থাৎ যে টাকা তাঁকে মজুরি দেওয়ার কথা বলে নেওয়া হচ্ছে তা দেওয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারটি সরকার প্রধানের দৃষ্টিগোচরে এসেছে শুনেছি। তাই এ ব্যাপারে একটি সমাধান আসতে পারে। এরপর যখন তাঁরা এসব বিষয়ে অভিযোগ করেন তার প্রতিকার পান না। এই প্রতিকারহীনতা, এই অবিচার দূর করার জন্য নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন আরেকটি প্রতারণা হলো ভিসা জালিয়াতি, দুই দেশের দুষ্ট চক্রই এ ক্ষেত্রে জড়িত। এ দেশে একটি রাজনৈতিক দুষ্ট চক্র এর সঙ্গে জড়িত। যারা অবৈধ হচ্ছে তাঁরা সেখানে যাওয়ার পর এসব দুষ্ট চক্রের প্রতারণার কারণেও অবৈধ হচ্ছে। এই বিষয়টিও বিবেচনায় রেখে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।’
কোভিড জাস্টিস ফান্ড ফর মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স নামে একটি ফান্ড করার প্রস্তাব দিয়ে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশ মিলে এটি করতে হবে। আমাদের অবশ্যই ব্যক্তির সমাধান দিতে। কাঠামোগত মজুরি চুরির মতো বিষয়গুলো সমাধানে আমাদের রাষ্ট্র, বিদেশি রাষ্ট্র, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’
রামরুর নির্বাহী পরিচালক ড. সি আর আবরার বলেন, ‘শ্রমিকদের মজুরি ও সম্মান যদি নিশ্চিত করতে না পারে তবে বিদেশে এই রাষ্ট্রের শ্রমিক পাঠানো উচিত না। স্বাস্থ্য ও ন্যায়বিচার এই দুটি ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে হবে। মজুরি চুরির বিষয়টি অন্তত নথিভুক্ত করা হোক। যাতে তাঁরা পরে হলেও ক্ষতিপূরণ পায়।’
প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি ও সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাজিম বলেন, ‘আমরা দেশে বসে প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্ট বুঝতে পারি না। তাঁদের অর্থে আমাদের অর্থনীতি সচল হচ্ছে। এসব শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলতে সরকার ভয় পায়। যদি ওই সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়। তবে এখন শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলা উচিত। তাঁরা যে চুক্তিতে যাচ্ছে সেসব সুবিধা পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আশা করি সরকার সে দায়িত্ব পালন করবে।’
অনুষ্ঠানে আগত অভিবাসী শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য রাখেন।
২৩ ডিসেম্বর ২০২২
সূত্র: প্রথম আলো
সূত্র: প্রথম আলো