যুক্তরাজ্য ইউরোপের বেশ কয়েকটি কঠোর অবস্থান নেওয়া সরকারের সাথে এক হয়ে মানবাধিকার আইন সীমিত করার আহ্বান জানিয়েছে। রুয়ান্ডা-ধাঁচের তৃতীয় দেশে অভিবাসন চুক্তি এবং বিদেশি অপরাধীদের দ্রুত বহিষ্কার নিশ্চিত করতে এই পরিবর্তন জরুরি বলে দাবি করেছে লন্ডন। ইউরোপ কাউন্সিলের ৪৬ সদস্যের মধ্যে ২৭টি দেশ একটি অনানুষ্ঠানিক বিবৃতিতে সই করে, যেখানে ECHR–এর (European Convention on Human Rights) বিভিন্ন ধারা পুনর্নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৩—যা “অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ” নিষিদ্ধ করে—তা “সবচেয়ে গুরুতর ক্ষেত্রে সীমিত” করার দাবি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, এই অনুচ্ছেদ যেন বিদেশি অপরাধীদের বহিষ্কার সিদ্ধান্তে আর বাধা না হয়, এমনকি কারাগারের অবস্থা বা স্বাস্থ্যসেবাকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত বিবাদেও। অপরদিকে অনুচ্ছেদ ৮—যা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের অধিকার রক্ষা করে—তা এমনভাবে সামঞ্জস্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে অপরাধের গুরুত্বকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং অপরাধীর পারিবারিক যোগসূত্রকে কম গুরুত্ব পায়।
এই অবস্থান মূলত রুয়ান্ডা-ধাঁচের নীতি পুনরায় চালুর আভাস দিচ্ছে। বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়, মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকলে কোনো দেশকে আশ্রয় ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তৃতীয় দেশের সঙ্গে মিলিতভাবে পরিচালনায় বাধা দেওয়া উচিত নয়। এ ধরনের ভাষা প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের ইউরোপের বাইরে পাঠানোর পরিকল্পনাকে আরও বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যদিও যুক্তরাজ্য, ইতালি, ডেনমার্ক, পোল্যান্ডসহ ২৭টি দেশ এই বিবৃতিতে সই করেছে, ফ্রান্স, স্পেন ও জার্মানি তা করেনি। তারা বরং একটি পৃথক, আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় সই করেছে যা মানবাধিকার কনভেনশনের ধারা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। এই দুই ভিন্ন অবস্থান ইউরোপে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ ও মানবাধিকার রক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর বিভাজন তৈরি করেছে।
স্ট্রাসবুর্গ বৈঠকে উপস্থিত যুক্তরাজ্যের উপ-প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেন, “বর্তমান নিয়ম যেন অবৈধ অভিবাসন মোকাবিলায় রাষ্ট্রগুলোকে বাধাগ্রস্ত না করে।” তার এই বক্তব্য লেবার সরকারের অভিবাসন নীতিতে ক্রমবর্ধমান চাপের প্রতিফলন। সাধারণ নির্বাচনের পর লেবার সমর্থন কমে যাওয়া এবং রিফর্ম ইউকের উত্থান—অনিয়মিত অভিবাসন ইস্যুকে আরও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর করে তুলেছে।
এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ম্যেটে ফ্রেডেরিকসন যৌথভাবে লিখেছেন যে “বর্তমান আশ্রয় কাঠামো অন্য এক যুগের জন্য তৈরি হয়েছিল” এবং তা নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াতে হবে। যদিও লেবার সরকার পূর্ববর্তী কনজারভেটিভ সরকারের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা ফিরিয়ে আনবে না বলেছে, তবু স্টার্মার তৃতীয় দেশে আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়াকরণের নতুন চুক্তির প্রতি উন্মুক্ত মনোভাব দেখিয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই প্রস্তাবকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে। ফ্রিডম ফ্রম টর্চারের ডিরেক্টর নাটাশা স্যাঙ্গারাইডেস সতর্ক করে বলেন, “এই সুরক্ষা দুর্বল করা হলে বিশ্বজুড়ে দমনমূলক সরকারগুলো নিজেদের নির্যাতন ন্যায্যতা দিতে শক্তি পেয়ে যাবে।” রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান এনভার সলোমন বলেন, “অধিকার সংকুচিত করলে মানুষ আসা বন্ধ করবে না; বরং তারা লুকিয়ে পড়বে এবং আরও শোষণের ঝুঁকিতে পড়বে।”
ইউরোপ কাউন্সিলের মহাসচিব আলাঁ বেরসে অবশ্য বলেন, সব ৪৬ দেশই মানবাধিকার আদালত ও কনভেনশনের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, অভিবাসন চাপ মোকাবিলায় দেশগুলো যে নজিরবিহীন সমস্যার মুখোমুখি, তা নতুন নীতিগত প্রশ্ন তৈরি করছে।
ইউরোপজুড়ে অভিবাসন সংকটের রাজনৈতিক ও মানবিক প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবাধিকার আইন পুনর্নির্ধারণের এই প্রচেষ্টা মহাদেশজুড়ে জোর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের নতুন অবস্থান সেই আলোচনা আরও তীব্র করেছে।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে

