7.6 C
London
March 12, 2025
TV3 BANGLA
যুক্তরাজ্য (UK)

যুক্তরাজ্যের যে অঞ্চলে চারজনের একজন নন-ইউকে পাসপোর্টধারী

যুক্তরাজ্যে ক্যামব্রিজ মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও সরু গলির জন্য পরিচিত। তবে শহরটিকে আলাদা করে তোলে আরেকটি বিষয়: এখানকার ২৮% বাসিন্দার নন-ইউকে পাসপোর্ট রয়েছে, যা ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের গড় ১০%-এর তুলনায় অনেক বেশি।

২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, লন্ডনের বাইরের যেকোনো স্থানীয় প্রশাসনিক এলাকায় নন-ইউকে পাসপোর্টধারীর জন্য এটি সর্বোচ্চ হার।

৫১ বছর বয়সী বর্নালি ঘোষ মনে করেন, ২৫ বছর আগে ভারত থেকে শিক্ষার্থী হিসেবে ক্যামব্রিজে আসা তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল।

তিনি বলেন, “আমি শহরটিকে খুব ভালোবেসেছিলাম। তবে শুরুর দিকে, চেনা কেউ না থাকলে, খুব একা লাগতে পারে।”

২০২১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে দেখা যায়, ভারত ক্যামব্রিজবাসীদের জন্মভূমির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

সেই সময় শহরে প্রায় ৪,০০০ ভারতীয় বাস করছিলেন, যা ১০ বছর আগের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ।

বার্নালি তার পিএইচডি শেষ করার পর ক্যামব্রিজে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং বলেন, অনেক ভারতীয় নাগরিক এখানকার অর্থনীতির কারণে আকৃষ্ট হন।

বর্নালি বলেন, “আইটি, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চিকিৎসা এবং শিক্ষা—এইসব বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে ভারতীয়রা সাধারণত পড়াশোনা করতে আসে ক্যামব্রিজে।”

বর্নালি ভারতীয় সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন আয়োজন পরিচালনা করেন, যেখানে কমিউনিটির মানুষ একত্রিত হয়ে উৎসব উদযাপন করেন, উপাসনা করেন, খাবার খান ও আড্ডা দেন।

তিনি বলেন, “ভারতীয়রা আনন্দ করতে ভালোবাসে, তাই আমরা এসব অনুষ্ঠানে যাই; আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো সবসময় হাসি-আনন্দে ভরে থাকে।”

তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো বৈষম্যের শিকার না হলেও, কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথাও শুনেছেন বলে জানান। অনেকের জন্য বাড়ি ভাড়া নেওয়া কঠিন হয়, কারণ কিছু বাড়িওয়ালা ভারতীয়দের ভাড়া দিতে চায় না।

নতুনদের জন্য বর্নালির পরামর্শ, “আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে; অন্যান্য কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে।”

ক্যামব্রিজের ৩৮% বাসিন্দা যুক্তরাজ্যের বাইরের জন্মগ্রহণকারী, যা ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের গড় ১৭%-এর তুলনায় অনেক বেশি। শহরটি বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও কর্মীদের আকৃষ্ট করে আসছে।

এখানে ৬০টিরও বেশি বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাঙ্গলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

ক্যামব্রিজের কলেজ ও অফিস ভবনগুলো শিক্ষার ও কর্মসংস্থানের সুযোগের প্রতীক হলেও, শহরে দারিদ্র্যও বিদ্যমান।

ক্যামব্রিজ রিফিউজি রিসেটলমেন্ট ক্যাম্পেইনের ট্রাস্টি ক্যাথারিন ওয়ালস্টন বলেন, শহরের অভিবাসীদের মধ্যে একটি ছোট অংশ শরণার্থী, যারা খুব সামান্য সম্পদ নিয়ে এখানে এসেছে। আমরা সুদানের একটি পরিবারকে স্বাগত জানিয়েছি, যাদের পাঁচজন সন্তান জাতিসংঘ পরিচালিত একটি শিবিরে জন্মেছিল এবং কখনো দন্তচিকিৎসকের কাছে যায়নি।

বর্তমানে শহরের প্রায় ১২০টি পরিবার এই সংস্থার সহায়তা পাচ্ছে। বেশিরভাগই পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে এসেছে, তবে কিছু পরিবার আইনি সহায়তার অধিকার পায়নি।

ক্যামব্রিজের জনসংখ্যার ০.৫%-এরও কম মানুষ, কোনো সরকারি আশ্রয় কর্মসূচি, ইউক্রেন ও আফগান পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে এখানে এসেছে।

ক্যাথারিন বলেন, ক্যামব্রিজে বসবাসকারী বেশিরভাগ নন-ইউকে পাসপোর্টধারী মোটেও সুবিধাবঞ্চিত নন, তবে একটি ছোট অংশ সমস্যার সম্মুখীন।

সংস্থাটি শরণার্থীদের ইংরেজি ভাষা শেখার সুযোগ দেয় এবং অন্যান্য সহায়তা যেমন—শিশুদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল, বিনামূল্যে ল্যাপটপ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে।

তিনি মনে করেন, ক্যামব্রিজের মানুষ সাধারণত শরণার্থীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রাখে। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি ভালো আঞ্চলিক কলেজ থাকায় এখানকার মানুষ শিক্ষিত, তাই বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাবনার গুরুত্ব বোঝে।

সেন্টার ফর সিটি’ নামক গবেষণা সংস্থার নগর অর্থনীতিবিদ পল সুইনি বলেন, অভিবাসন ক্যামব্রিজের একটি বৃহত্তর গল্পের অংশ। ক্যামব্রিজ উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এক অনন্য স্থান। যখন আপনি ক্যামব্রিজে অবস্থিত আধুনিক প্রযুক্তির কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলবেন, তারা বলবে বৈশ্বিক প্রতিভার সহজলভ্যতা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি জানান, কোম্পানিগুলো আরও গবেষণাগারের স্থান ও কর্মীদের জন্য আবাসন চাচ্ছে, তবে সমাজের কিছু অংশ তা চায় না।

তিনি বলেন, “অনেকেই নতুন বাড়ি নির্মাণ হোক তা চান না; তারা ক্যামব্রিজকে আগের মতোই রাখতে চান।”

সরকার সম্প্রতি গ্রেটার ক্যামব্রিজ এলাকায় বার্ষিক গৃহায়ন লক্ষ্যমাত্রা ২,৩০৯ বাড়িতে উন্নীত করেছে।

ক্যামব্রিজ সিটি কাউন্সিলের লেবার নির্বাহী সদস্য জেরি বার্ড বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহরটি ভয়াবহ আবাসন সংকটের মুখোমুখি হয়েছে।

২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শহরের জনসংখ্যা ১৭.৬% বেড়ে ১,৪৫,৭০০ হয়েছে, যা পূর্ব ইংল্যান্ডের অন্য যেকোনো এলাকার তুলনায় বেশি।

জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ক্যামব্রিজে গড় বাড়ির দাম ছিল £৫১৫,০০০, যা যুক্তরাজ্যের গড় £২৭১,০০০-এর তুলনায় অনেক বেশি।

একই সময়ে, শহরের ব্যক্তিগত ভাড়ার গড় ছিল £১,৭৫৫, যা যুক্তরাজ্যের গড়ের তুলনায় ৩২% বেশি।

বার্ড বলেন, “এই সংকট দীর্ঘদিনের বাসিন্দা থেকে শুরু করে স্কুল, হাসপাতাল, কেয়ার হোম ও স্থানীয় কাউন্সিল কর্মীদেরও প্রভাবিত করছে।”

তবে তিনি স্বীকার করেন, নতুন নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট নাও হতে পারেন। পরিবর্তনের সময়টা ভয়ংকর ও কঠিন হতে পারে, আমি তা বুঝতে পারি। আমরা সেইসব বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি, যাদের এলাকা উন্নয়নের জন্য বিবেচিত হচ্ছে এবং তাদের জন্য বাস্তবসম্মত সহায়তা প্রদান করি।”

৪৭ বছর বয়সী রীম আসিল ক্যামব্রিজের উত্তরে ওয়াটারবিচ এলাকায় থাকেন। তার জন্ম লন্ডনে, তবে জীবনের বেশিরভাগ সময় দামাস্কাসে কাটিয়েছেন।

একজন সাবেক কর্মী (অ্যাকটিভিস্ট) হিসেবে তিনি ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় সমস্যায় পড়েন এবং নিরাপত্তার খোঁজে দক্ষিণ ফ্রান্সে চলে যান।

পরে ২০১২ সালে তিনি ক্যামব্রিজে আসেন, যেখানে তিনি তার ইমিউনোলজি পিএইচডি কাজে লাগাতে এবং তার দুই ছেলেকে বড় করতে চেয়েছিলেন। যারা তখন পাঁচ ও ১০ বছর বয়সী ছিল।

তিনি শহরটিকে ভালোবেসে ফেললেও, শুরুর দিকে একাকিত্ব অনুভব করতেন।

তিনি বলেন, “আমি চেয়েছিলাম আরব সংস্কৃতি চর্চা করতে, কিন্তু এখানে সেই সুযোগ ছিল না। আমার ছোট ছেলে আরবি পড়তে বা লিখতে পারত না।”

২০২৩ সালে, রীম তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করে ‘মাকানি’ (যার অর্থ আরবিতে ‘আমার জায়গা’) নামের একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন, যা আরব সংস্কৃতি উদযাপন করে।

তিনি গ্রীষ্মকালে একটি ঈদ-উল-ফিতর উৎসব আয়োজন করেন এবং মাঝে মাঝে ড্রামিং ও নাচের সেশন পরিচালনা করেন।

তিনি বলেন, ” আমরা একটু ড্রাম বাজাতাম, একটু নাচতাম, তারপর বিরতি নিতাম; মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠত।”

তিনি জানান, বিভিন্ন বয়স ও পটভূমির মানুষ এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে তিনি চান, মাকানি অন্যান্য সংস্কৃতির মানুষদের জন্যও উন্মুক্ত হোক। আমাদের লক্ষ্য বিভক্তি তৈরি করা নয়, বরং সবাইকে একত্রিত করা।

সূত্রঃ বিবিসি

এম.কে
১২ মার্চ ২০২৫

আরো পড়ুন

লন্ডনে ফেলে দেওয়া চুইংগাম সরাতেই বছরে খরচ ৪০ লাখ ডলার

যুক্তরাজ্যের স্কুলে শিশু সন্তানদের অভিভাবকদের জন্য কঠিন নিয়ম চালু

যুক্তরাজ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি, বিপাকে মানুষ