যুক্তরাজ্যে ধূমপান ছাড়াতে ব্রিটিশ ধূমপায়ীদের বিনামূল্যে ভ্যারেনিক্লাইন নামে ধূমপানরোধী এক ধরনের ট্যাবলেট দেবে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস)। চলতি সপ্তাহে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান নির্বাহী আমান্ডা প্রিচার্ড এ বিষয়ে এক ঘোষণা দেন।
কেউ একবার ধূমপানের মতো বাজে অভ্যাসে আসক্ত হয়ে গেলে তার পক্ষে এটা ছেড়া দেয়া বা এর থেকে বের হয়ে আসা কঠিন। এর জন্য প্রচণ্ড মনোবল প্রয়োজন। যারা ধূমপান ছেড়ে দিতে চান, তাদের জন্য কিছু ক্লিনিক্যাল থেরাপি রয়েছে। যেমন নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি।
নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) অনুমোদিত ১২ সপ্তাহের একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যা ধূমপায়ীদের আসক্তি কমাতে ও ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করে। এটা মূলত চিউইংগাম বা ট্রান্সডার্মাল প্যাচের মাধ্যমে দেয়া হয়।
ট্রান্সডার্মাল প্যাচ হল একটি ওষুধযুক্ত আঠালো প্যাচ যা ত্বকের মাধ্যমে এবং রক্তের প্রবাহে ওষুধের একটি নির্দিষ্ট ডোজ সরবরাহ করার জন্য ত্বকে স্থাপন করা হয়।
তবে নতুন গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ‘ভ্যারেনিক্লাইন’ ট্যাবলেট সেবন চিউইং গাম বা প্যাচ থেরাপির চেয়েও বেশি কার্যকর। ট্যাবলেটটি এখন ব্রিটিশ ধূমপায়ী ধূমপান ছাড়াতে সরকারিভাবে ব্যবহার করা হবে।
ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে প্রায় ৮৫ হাজার ধূমপায়ীকে এই ধূমপানরোধী ওষুধ দেয়া হবে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের চালানো এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, এই ট্যাবলেট আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ ধূমপান-সংক্রান্ত মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
এনএইচএস প্রধান আমান্ডা প্রিচার্ড বলেন, ‘যারা ধূমপান ছাড়তে চান তাদের জন্য নিয়মিত এই ট্যাবলেট সেবন ‘গেম চেঞ্জার’ বা যুগান্তকরী হতে পারে।’ প্রশ্ন হল, নতুন ওষুধটি কীভাবে কাজ করবে আর কীভাবেইবা গুরুতর ধূমপান-সম্পর্কিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করবে?
যুক্তরাজ্যে পরিবারগুলোর ওপর পরিচালিত ২০২৩ সালের বার্ষিক জনসংখ্যা জরিপ অনুসারে, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ১১.৯ শতাংশ অর্থাৎ বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ ব্রিটিশ ধূমপায়ী।
যুক্তরাজ্যে রাজ্য হিসেবে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীদের সংখ্যা নিম্নরূপ: ইংল্যান্ড ১১.৬%, ওয়েলস ১২.৬%, স্কটল্যান্ড ১৩.৫% ও উত্তর আয়ারল্যান্ড ১৩.৩%।
চ্যাম্পিক্স নামের একটি পুরোনো ওষুধের নতুন সংস্করণ এই ভ্যারেনিক্লাইন। দেশটিতে ধূমপায়ীদের সংখ্যা হ্রাস এবং এনএইচএসের সামগ্রিক ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ হিসেবে নতুন ট্যাবলেটটি বাজারে আনছে যুক্তরাজ্য।
২০০৬ সালে ফাইজার নামে একটি ওষুধ কোম্পানির তৈরি এই ধূমপানবিরোধী ওষুধের ব্র্যান্ড নাম ছিল চ্যাম্পিক্স। তবে ২০২১ সালের অক্টোবরে এটি বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। কারণ এতে নাইট্রোসামিন নামক একটি উপাদান ছিল, যা একটি পরিচিত ক্যান্সার সৃষ্টিকারী (কার্সিনোজেন) পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত।
জানা গেছে, ওষুধে নাইট্রোসামিন নামক পদার্থটি ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) এবং মেডিসিন্স অ্যান্ড হেলফ কেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সির (এমএইচআরএ) নির্ধারিত গ্রহণযোগ্য সীমার চেয়ে বেশি ছিল। এর ফলে স্থানীয় ফার্মেসি ও পাইকারি বিক্রেতাদের ওষুধটি বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
২০২৪ সালের আগস্টে ভ্যারেনিক্লাইন নামে এই ধূমপানরোধী ওষুধটি ফের যুক্তরাজ্যের বাজারে আনা হয় এবং চলতি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ওষুধটি এমএইচআরএর অনুমোদন পেয়েছে।
ভ্যারেনিক্লাইন একটি ‘নিকোটিন রিসেপ্টর অ্যাগোনিস্ট’ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এটি এমন একটি পদার্থ, যা মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট ধরনের রিসেপ্টরকে সক্রিয় করে। এই অ্যাগোনিস্ট নিকোটিনের মতোই মস্তিষ্কের সেই অঞ্চলে কাজ করে, যেখানে নিকোটিন প্রভাব ফেলে।
ওষুধটি মস্তিষ্কে নিকোটিনের প্রভাব কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি ধূমপানের প্রতি আসক্তি এবং উদ্বেগজনক উপসর্গ কমিয়ে দেয়। এর ফলে নিকোটিন ছাড়াই রোগী রিসেপ্টরগুলো সক্রিয় করার সুযোগ পায়। চিকিৎসকরা নিকোটিনের নেশা পুরোপুরি দূর করতে ১২ থেকে ২৪ সপ্তাহ এই ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
এনএইচএসের তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন এক থেকে দুটি ট্যাবলেট গ্রহণ করা উচিত এবং ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করার এক বা দুই সপ্তাহ আগে ট্যাবলেট গ্রহণ শুরু করা উচিত।
এনএইচএস ওষুধটির নিম্নলিখিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছে: অসুস্থ বোধ করা, ঘুমের অসুবিধা (অনিদ্রা), মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখা, মুখের মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করা ও মাথা ঘুরানো।
ল্যানসেটের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি ধূমপায়ীকে ভ্যারেনিক্লাইন সেবনে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ধূমপান ছেড়ে দেয়ার জন্য নিকোটিনের বিকল্প পণ্য ব্যবহার করা মানুষদের নিয়ে করা গবেষণাগুলোর ফলাফল খুব বৈচিত্র্যময়।
যদিও ক্লিনিক্যাল স্টাডিগুলো বিভিন্ন রকম। তবুও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪ থেকে ৫০ শতাংশ ধূমপায়ী এর সাহায্যে সফলভাবে ধূমপান ছাড়তে পেরেছেন। তবে এটা নির্ভর করে নির্দিষ্ট (স্টাডি ও ট্রায়াল) গবেষণা ও প্রয়োগের মেয়াদের ওপর।
যদিও ধূমপান ছাড়তে ব্যবহারের জন্য চিউইংগাম বা ট্রান্সডারমাল প্যাচ থেরাপি ও নিকোটিন স্প্রেসহ অনেকগুলো বিকল্প থেরাপি রয়েছে। তবে বেশিরভাগ গবেষক একটি বিষয়ে একমত যে, ভ্যারেনিক্লাইন ও অন্যান্য ধূমপান ছাড়ানোর ওষুধগুলো ধূমপান ছাড়াতে সহায়তার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি।
ধারণা করা হয়, প্রায় ১০ শতাংশ ধূমপায়ী নিজে নিজে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে সফলভাবে ধূমপান ছাড়তে পেরেছেন।
সূত্রঃ আল জাজিরা
এম.কে
২১ নভেম্বর ২০২৪