২০০৫ সালের সাত জুলাইয়ের লন্ডন বোমা হামলার দুই দশক পার হলেও মুসলমানদের মধ্যে ভয়, সন্দেহ ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এখনও কাটেনি। এই দীর্ঘ সময়ে সন্ত্রাসবিরোধী নীতিমালা ও উগ্র ইসলামবিদ্বেষ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে বলে মনে করছেন মুসলিম নেতৃবৃন্দ।
হামলার পরপরই মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর বাড়তি নজরদারি, পুলিশি হয়রানি ও ধর্মীয় ঘৃণাভিত্তিক অপরাধ বেড়ে যায়। মাত্র তিন দিনে ১৮০টি বর্ণবাদী ঘটনা নথিভুক্ত হয়, যার মধ্যে ৫৮টি ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত। বহু মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে, এবং অনেক মুসলমান দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেন।
ইমাম ক্বারী আসিম বলেন, মুসলমানদের মধ্যে শুধু শোকই নয়, বরং আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার লড়াইও শুরু হয়। লন্ডনের হামলাকারীদের তিনজন লিডস থেকে আসায়, স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে অতিরিক্ত অপরাধবোধ ও চাপ তৈরি হয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভিড়ের মধ্যে আসিম স্থানীয় উপাসনালয়গুলোর সঙ্গে শান্তি পদযাত্রা করেন। মসজিদগুলোতে দেওয়া খুতবায় সহনশীলতা ও উগ্রবাদবিরোধী বার্তা প্রচার করা হয়। কিন্তু তারপরও মানুষ তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতো, এমনকি ব্যাগ বহন করাও তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
টনি ব্লেয়ার সরকারের সময় প্রণীত ১২টি সন্ত্রাসবিরোধী আইন মুসলমানদের ওপর আরও নজরদারি এবং নিপীড়নের পথ খুলে দেয়। পুলিশি থামিয়ে তল্লাশি ও বিশ্বাসভিত্তিক ঘৃণার অভিযোগ ক্রমেই বাড়তে থাকে। মুসলমানদের ধর্ম যেন এক ধরনের অপরাধে পরিণত হয়।
রেইস ইকুয়ালিটি সংস্থা ‘রানিমিড ট্রাস্ট’-এর প্রধান শাবনা বেগম বলেন, দক্ষিণ এশীয় এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী ক্ষমতার প্রয়োগ ছিল একপেশে এবং বর্ণবাদী। তার নিজের সন্তানদেরও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠার ভয় থাকে।
মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের তথ্য মতে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩৯ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬.৫ শতাংশ। এর বড় অংশই ১৯ বছরের নিচে বয়সী।
‘প্রিভেন্ট’ নামক সরকারিভাবে চালু হওয়া কর্মসূচি সন্ত্রাসের মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলে। বহু শিশু ও শিক্ষার্থীকে সন্দেহজনকভাবে তলব করা হয়, যার ফলে কর্তৃপক্ষের ওপর বিশ্বাস নষ্ট হয়।
২০০৫ সালের হামলার পর কিছু ইতিবাচক দিক যেমন বেড়েছে—মুসলমানদের জনজীবনে অংশগ্রহণ, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা গঠন—তবে রাজনৈতিক এবং গণমাধ্যমে মুসলমানদের নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।
২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ‘জিবি নিউজ’ দুই বছরে মুসলমানদের নিয়ে প্রচারিত সংবাদ কভারেজের অর্ধেকের বেশি করেছে, যার অধিকাংশ ছিল নেতিবাচক। এই বাস্তবতা সাধারণ মানুষকেও উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
মুসলিম ওমেনস নেটওয়ার্ক ইউকে’র প্রধান শায়েস্তা গোহির বলেন, তিনি জীবনে সবসময়ই বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন, কিন্তু এখনকার মতো কখনো এতটা শঙ্কিত হননি। তার মতে, এখন ইসলামবিদ্বেষ শুধু প্রান্তিক গোষ্ঠীতে নয়, বরং মূলধারাতেই স্থান করে নিয়েছে।
২০ বছর পরও মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস ও বৈষম্য কমেনি বরং বেড়েছে—এই অনুভূতি আজও ব্রিটিশ মুসলমানদের মানসিক ও সামাজিকভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে। নেতৃবৃন্দ এখন ন্যায়ভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক নীতিমালার দাবি জানাচ্ছেন।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
১৪ জুলাই ২০২৫