যুক্তরাজ্যের কেন্টের রামসগেটের বাইরে প্রাক্তন সামরিক ঘাঁটি ম্যানস্টনে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ছোট নৌকায় চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা মানুষগুলো একের পর এক তাঁবুতে সাক্ষাৎকার ও নিরাপত্তা যাচাইয়ের ধাপ পেরোন। পৌঁছেই তাদের ফোনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে নীল প্লাস্টিক ব্যাগে রাখা হয়। টিভি পর্দায় তখন ভেসে ওঠে সতর্কবার্তা—তারা অবৈধভাবে ফ্রান্স থেকে এসেছে, তাই যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পাবে না।
নিয়ম অনুযায়ী এখানে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা থাকার কথা থাকলেও অনেককে দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়। ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে অন্তত ২৫০ জন আশ্রয়প্রার্থী হোম অফিসের বিরুদ্ধে অবৈধ আটক ও অধিকার লঙ্ঘনের মামলা করেছেন। সে সময় ধারণক্ষমতা ১,৬০০ হলেও সেখানে রাখা হয়েছিল ৪,০০০ মানুষকে। ডিপথেরিয়া ও স্ক্যাবিসের মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে, এবং সেই বছর নভেম্বর মাসে কুর্দি তরুণ হোসেন হাসিব আহমেদ ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সাবেক অভিবাসন পরিদর্শক ডেভিড নিল পর্যন্ত স্বীকার করেন, অবস্থা এত ভয়াবহ ছিল যে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হলেও এখনও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। তথ্য বলছে, ২০২২ সালে যেখানে মাত্র ৭ জনকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ জনে। নৌকায় ভিড়ে চাপা পড়া, হাড়ভাঙা কিংবা সমুদ্রযাত্রার কারণে সংক্রামক রোগ নিয়ে বহু মানুষ ম্যানস্টনে আসেন।
কর্মীরা বলছেন, আশ্রয়প্রার্থীরা কয়েক দিন না খেয়ে বা না ঘুমিয়ে পৌঁছান। অনেকে এতটাই ক্লান্ত যে হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়েন। কেউ কেউ ভোর থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শক্ত চেয়ারে বসে থাকেন, বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। বাচ্চাদের শরীরে নোনতা সমুদ্রের পানির কারণে চুলকানি লেগেই থাকে। এক আফগান তরুণ কর্মীদের বলেন, “আমাকে যদি এক মিলিয়ন পাউন্ডও দেওয়া হয়, তবু আমি আর সেই সমুদ্রে যাব না। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি মারা যাব।”
তবে মানবিকতার অভাবও স্পষ্ট। এক কর্মী বরখাস্ত হয়েছেন ঘুমন্ত কাউকে পা দিয়ে জাগানোর কারণে, আরেকজনকে চাকরি হারাতে হয়েছে এক শিশুকে টেনে তোলার পর অবমাননাকর মন্তব্য করায়। গত বছর ২৯ জন কর্মী মাদক পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় বরখাস্ত হন। এমনকি বর্ণবাদী বার্তা ওয়াকিটকিতে প্রচার হওয়ায় তদন্তও শুরু হয়েছে।
মানবিক সহমর্মিতার বদলে অনেক সময় আশ্রয়প্রার্থীদের বলা হয়—“যদি ভালো না লাগে, নৌকায় ওঠা উচিত ছিল না।” একইসঙ্গে যুদ্ধ থেকে পালানো মানুষদের সামনে টিভিতে যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা চালানো হয়। এক কর্মীর ভাষায়, “এটি নিশ্চয়ই নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু নয়।”
তবুও কিছু কর্মী তাদের গল্প শুনে মুগ্ধ। এক ভিয়েতনামি ছেলের গল্প শোনান, যে অঙ্গ পাচারকারীর হাত থেকে পালিয়েছে। আরেকজন উল্লেখ করেন ৭৪ বছর বয়সী আফগান নারীর কথা, যিনি একা পথ পাড়ি দিয়েছেন। অনেক কর্মী আশ্রয়প্রার্থীদের ধৈর্য ও ভদ্রতা দেখে বিস্মিত। একজন বলেন, “তাদের জীবনেরও একটি উদ্দেশ্য আছে। সহকর্মীদের বলি—একবার তাদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখুন।”
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫