বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির এক অতি সংবেদনশীল অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সামান্য ভুল পদক্ষেপই রাষ্ট্রীয় স্বার্থে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থান, দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগরের সংযোগবিন্দু হওয়া এবং প্রতিবেশী ও মহাশক্তিগুলোর প্রভাবের কারণে দেশটি এক বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব অর্জন করেছে। এই অবস্থানটি একে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ভারত মহাসাগরকে তাদের কৌশলগত নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগে সম্প্রসারণ আমেরিকার নজর কাড়ছে। তাই মার্কিন দৃষ্টিতে বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি ‘সতর্ক সংকেত’ হিসেবে বিবেচিত।
চীনও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানকে তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ মনে করে। চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দর, মিয়ানমারের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সড়ক ও জ্বালানি করিডর—এসব চীনের দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বৃদ্ধির মূল কৌশল। অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে চীন একটি স্থিতিশীল, নির্ভরযোগ্য এবং তাদের প্রতি কৌশলগতভাবে অনুগত বাংলাদেশ দেখতে চায়।
রাশিয়া বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতিতে একটি স্বাধীন অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়। বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক স্বার্থ এবং জ্বালানি খাতে অংশগ্রহণ রাশিয়াকে এই অঞ্চলে সক্রিয় রেখেছে। তবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও চাপও বাংলাদেশকে প্রভাবিত করে, ফলে রাশিয়ার সম্পর্ক বজায় রাখাটাও জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে সবসময়ই শক্তিশালী প্রভাব প্রয়োগ করে। সীমান্ত, অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি ও নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এই পরোক্ষ প্রভাব দেশের স্বাধীন কূটনীতি বাস্তবায়নকে কঠিন করে তোলে।
বাংলাদেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বড় শক্তির প্রতিযোগিতাকে ঝুঁকির উৎসে পরিণত করে। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া ও ভারতের চাপের মধ্যে সমন্বয় রেখে একটি স্বাধীন কূটনৈতিক নীতি চালানো বড় চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক বিভাজন বিদেশি চাপকে সহজে প্রবেশের সুযোগ দেয়।
অতএব, বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন দক্ষ নেতৃত্ব, সুস্পষ্ট কূটনীতি ও জাতীয় ঐক্য। বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মহাসড়ক হিসেবে দেশকে শক্তিশালী করা সম্ভব, তবে এর জন্য রাজনৈতিক দৃঢ়তা, সতর্ক কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা অপরিহার্য।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল পার করার সক্ষমতার উপর। স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও বুদ্ধিমান কূটনীতি নিশ্চিত করলে দেশটি শুধু টিকে থাকবে না, বরং শক্তিশালী ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠবে।
সূত্র ও লেখকঃ সিরাজুল ইসলাম
এম.কে

