ইহুদিবাদী কিছু কর্মকর্তা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠী বিশেষ করে হামাসের ওপর অভূতপূর্ব চাপ সৃষ্টির কথা বললেও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছেন ইসরাইলি মিডিয়া বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, হামাস দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, ভেঙে পড়া কিংবা আত্মসমর্পণের কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে নেই।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাবের বিষয়ে হামাসের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ার জবাবে ইসরাইলি ইয়েদিয়োত আহারোনোথ পত্রিকার বিশ্লেষক অভি ইয়াসাখরফ বলেছেন, ‘হামাসের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়, ইসরাইলের দাবির কাছে মাথা নত করে হামাস যে তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছে এবং পতনের কাছাকাছি- এমন কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে নেই’।
ইরানী সংবাদ মাধ্যম ইসনার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইলি বিশ্লেষক স্বীকার করে বলেছেন, ‘আত্মসমর্পণ বা অস্ত্র হস্তান্তরের কোনো ইচ্ছাই হামাসের মধ্যে দেখা যায়নি’।
এ প্রসঙ্গে ইসরাইলি দৈনিকটির আরেক বিশ্লেষক আসাভ মেয়দানি দখলদার ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত নাজুক বলে বর্ণনা করে বলেছেন।
তার ভাষায়, ‘সমস্যা হলো- ইসরাইল আর মাসের পর মাস ধরে চলা অচলাবস্থা সহ্য করতে পারছে না। দেশটি এখন সামরিক ক্ষেত্রে, দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে পুনর্গঠন কাজ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি, পশ্চিমা চাপ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন’।
আসাভ মেয়দানি আরও বলেন, ‘ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একমাত্র লক্ষ্য তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করা, যা চলমান সমস্যাকে আরও তীব্রতর করেছে’।
এই বিশ্লেষণগুলো এমন এক পরিস্থিতিতে করা হয়েছে, যখন হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত আলোচনায় অচলাবস্থা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি মার্কিন মধ্যস্থতা এখনো কোনো ফল এনে দিতে পারেনি।
এদিকে সর্বশেষ মার্কিন প্রস্তাবের প্রতি হামাসের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় যে, তারা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং অবরোধ প্রত্যাহারের ওপর জোর দিলেও তেলআবিব এখনো পর্যন্ত এ ধরনের শর্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।
শনিবার সন্ধ্যায় হামাস ঘোষণা করেছে যে, তারা গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য উইটকফের প্রস্তাবের প্রতি ‘ইতিবাচক’ সাড়া দিয়েছে। সেই সঙ্গে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের স্থায়ী সমাপ্তি চেয়েছে।
তবে হামাসের এই প্রতিক্রিয়াকে ’অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তার দাবি, হামাসের এই প্রতিক্রিয়া চলমান আলোচনাকে পিছিয়ে দিয়েছে।
তবে হামাস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে, ‘আমাদের প্রতিক্রিয়া চুক্তির কাঠামোর মধ্যেই ছিল। কিন্তু ইসরাইলের তরফে এমন আচরণ করা হচ্ছে, যা চুক্তির শর্তাবলীর পরিপন্থি’।
রোববার এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, ‘হামাসের প্রতি উইটকাফের অবস্থান অন্যায্য এবং সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট। তিনি মধ্যস্থতার ভূমিকায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেননি’।
এদিকে, যুদ্ধবিরতি আলোচনার মধ্যেই দক্ষিণ গাজার রাফাহর পশ্চিমে আল-মাওয়াসি এলাকায় ত্রাণ সংগ্রহে যাওয়া সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে বর্বর ইসরাইলি বাহিনী। রোববারের এ ঘটনায় প্রায় ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ২০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়টি আরও জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ২৮ জনের মরদেহ খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে এবং ২১ জনের মরদেহ রেড ক্রসের ফিল্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আহতদের অধিকাংশই ইসরাইলি গুলিবর্ষণে জখম হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এদিন ভোর থেকেই আমেরিকান বেসরকারি সংস্থা ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে প্রচুর মানুষ জড়ো হন। তবে লোকজন যখন ওই কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছায়, তখনই ইসরাইলি সামরিক যানবাহন থেকে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। এমনকি ড্রোন থেকেও বিস্ফোরক ফেলতে শুরু করে। যার ফলে ব্যাপক হতাহত হয়।
এক চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেন, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের আশপাশের পরিস্থিতি ছিল ‘চরম বিপজ্জনক’। সেখানে উপর্যুপরি গুলিবর্ষণের কারণে অ্যাম্বুলেন্সগুলো আহতদের কাছে পৌঁছাতে পারছিল না। অনেককে ঠেলাগাড়িতে করে সরিয়ে নিতে হয়েছে।
একই সময়ে, গাজার কেন্দ্রস্থলে নেটজারিম করিডোরের কাছে আরেকটি আমেরিকান ত্রাণকেন্দ্রের দিকে আসা সাধারণ মানুষের ওপরও ইসরাইলি সেনারা গুলি চালায় বলে জানান আরও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।
নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের আল-আউদা হাসপাতালের চিকিৎসা সূত্রে জানা গেছে, বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের কাছে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত একজন ফিলিস্তিনি নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে দখলদার ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র অভিচাই আদ্রেয়ি দাবি করেছেন, ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে সেনাবাহিনীর গুলিতে হতাহত হওয়ার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে ‘ঘটনাটি তদন্তাধীন’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস বলেছে, ‘ইসরাইল পরিকল্পিত ও নিষ্ঠুরভাবে মানবিক ত্রাণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। যাতে অনাহারে থাকা বেসামরিকদের ব্ল্যাকমেইল করে তাদের উন্মুক্ত হত্যাযজ্ঞের এলাকায় জড়ো করা যায়’।
এদিকে দখলদার ইসরাইল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্মম সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে। অব্যাহত অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৪,৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন—যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস তাদের মৃতের সংখ্যা ৬১,৭০০-এরও বেশি আপডেট করেছে। জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষ মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্রঃ ইসনা
এম.কে
০২ জুন ২০২৫