প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলা টানাপোড়েনের পর চীন ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সম্প্রতি কিছুটা ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। ২০২৫ সালে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক লেনদেন বেড়েছে। সদিচ্ছার অংশ হিসেবে চলতি বছরের মার্চে চীন ভারতীয় নাগরিকদের ওপর আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং ভিসানীতি শিথিল করে। এর ফলে ভারতীয়দের জন্য চীনে ভ্রমণ আগের তুলনায় সহজ হয়।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পরপরই চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ডৌইনসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ভারতীয় পর্যটকদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সাবওয়েতে হাত দিয়ে খাবার খাওয়া কিংবা পর্যটন এলাকায় গোসল করার মতো দৃশ্য দেখিয়ে ভারতীয়দের আচরণ নিয়ে সমালোচনা করা হয়। এসব ভিডিও ঘিরে দ্রুত ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং মন্তব্যের বড় অংশ হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণ।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া মন্তব্যে অনেক ক্ষেত্রেই বর্ণবাদী ভাষা ব্যবহার করা হয়। কিছু ব্যবহারকারী দাবি করেন, চীনে ভারতীয় পর্যটকদের প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করা উচিত। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে চীনে বসবাসরত সব ভারতীয়কে বহিষ্কারের কথাও বলেন। হাজার হাজার মন্তব্যের ভিড়ে সংযত বা তথ্যভিত্তিক মতামত প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়।
এই মনোভাবের পেছনে ভারতীয়দের নিয়ে প্রচলিত নানা নেতিবাচক ধ্যানধারণা কাজ করছে। চীনের সামাজিক মাধ্যমে প্রায়ই ভারতীয়দের অপরিচ্ছন্ন বা নৈতিকভাবে দুর্বল হিসেবে তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় অভিবাসীরা নাকি স্থানীয় সুযোগ-সুবিধা দখল করে নিচ্ছে—এমন বিভ্রান্তিকর তথ্যও ছড়ানো হয়েছে। যদিও এসব দাবির বাস্তবভিত্তি নেই, তবু অনেক চীনা নেটিজেন মনে করছেন, চীনও ভবিষ্যতে ভারতীয় অভিবাসনের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চীনের মূল ভূখণ্ডে বসবাসরত প্রবাসী ভারতীয়ের সংখ্যা মাত্র ৮ হাজার ৪৬০ জন। এই সংখ্যা হংকংয়ে থাকা ভারতীয়দের তুলনায় অনেক কম, যেখানে প্রবাসী ভারতীয়ের সংখ্যা ৪৪ হাজারের বেশি। জাপানে ভারতীয় আছেন প্রায় ৪৮ হাজার এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৭ হাজারের মতো। অর্থাৎ সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে ‘ভারতীয়দের গণ অভিবাসন’ দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার বড় ধরনের অমিল রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘাতের পর চীন–ভারত যোগাযোগ দীর্ঘদিন সীমিত থাকায় এবং চীনা সামাজিক মাধ্যমের তুলনামূলকভাবে বদ্ধ পরিবেশের কারণে ভুল তথ্য সহজে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে না। এতে প্রচলিত ধ্যানধারণা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি চীনা সমাজে ভারতবিরোধী বক্তব্যের প্রতি দীর্ঘদিনের সহনশীলতাও এই প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে।
চরম জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা বর্ণবাদের শিকার হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও একই সময়ে ভারতকে ব্যর্থ ও মূল্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখাতে দ্বিধা করে না। তাদের কাছে ভারত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় চীনের তুলনায় দুর্বল একটি প্রতিপক্ষ, যাকে আক্রমণ করে নিজেদের নিরাপত্তাবোধ ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা বজায় রাখা যায়।
এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাবকে চীনা সরকারের সরাসরি সমর্থন হিসেবে দেখার সুযোগ কম। মহামারির বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর সরকার এখন মূলত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দিচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্যে ভিসানীতি শিথিলসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় নাগরিকদের জন্য প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার ভিসা ইস্যু করেছে চীন।
এই উদ্যোগগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, চীনের কাছে ভারত এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ও বড় বাজার। বিশেষ করে চীনা পণ্যের অন্যতম বড় ক্রেতা হিসেবে ভারতের ভূমিকা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়ার পেছনে সরকারের কৌশলগত আগ্রহ থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বরং অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চ বেকারত্ব ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা থেকে জন্ম নেওয়া সামাজিক উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই এই ভারতবিরোধী আবেগ দেখা দিচ্ছে। বাস্তবে অস্তিত্বহীন ‘ভারতীয়দের গণ অভিবাসন’কে সীমিত চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা হিসেবে কল্পনা করা হচ্ছে। যেহেতু ভিসা দিচ্ছে সরকার, তাই এই ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে রাষ্ট্রীয় নীতিও।
আগস্টে ঘোষিত তরুণ বিদেশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিভাদের জন্য ‘কে ভিসা’ কর্মসূচিকেও কিছু গোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ব্যাখ্যা করছে। বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় চীনে প্রবেশ করবে। এমনকি চীনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ও অভিবাসন কর্মকর্তাদের ঘিরেও গুপ্তচরবৃত্তির ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়ানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অভিযোগ আসলে গভীর সামাজিক উদ্বেগ ও আস্থাহীনতার প্রতিফলন। জাতীয়তাবাদী ভাষ্য স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক সংহতি তৈরি করলেও দীর্ঘমেয়াদে তা উল্টো ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। কারণ সরকার যখন ক্রমেই উগ্র হয়ে ওঠা জনমতকে সামাল দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই জাতীয়তাবাদই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জে পরিণত হতে পারে।
সূত্রঃ দ্য ডিপ্লোম্যাট
এম.কে

