সাবেক ফুটবলার, ইংলিশ ক্রীড়া উপস্থাপক ও সম্প্রচারক গ্যারি লিনেকার তার ‘নেক্সট এক্স গ্যারি লিনেকার রেঞ্জ’ প্রকল্পের আওতায় একটি ধূসর-সবুজ রঙের জ্যাকেট পরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের দাবি, এই জ্যাকেটটি যারা তৈরি করেছেন সেই কর্মীরা এর জন্য খুবই কম মজুরি পেয়ে থাকেন। তাদেরকে প্রতি ঘণ্টায় বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ টাকা দেয়া হয়।
বাংলাদেশে তৈরি এই জ্যাকেটটি পরে বিবিসির নিয়ম লঙ্ঘন করার অভিযোগের মুখেও পড়েছেন লিনেকার।
৬৩ বছর বয়সী এই ক্রীড়া উপস্থাপক-বিশ্লেষক ১৬ জুন সার্বিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ইউরোর ম্যাচে ব্যবসায়িক উদ্দেশে তার নিজস্ব পোশাকের প্রচার করেন। এতে বিবিসির নির্দেশিকা লঙ্ঘন করার জন্য ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি।
৫৫ পাউন্ড দামের জ্যাকেট পরে তিনি ব্যাপক প্রশ্নের সম্মুখীন। বাংলাদেশের দারিদ্র্য অবস্থায় বসবাসকারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের তৈরি করা জ্যাকেটটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী খাদিজা খাতুন লিনেকার ‘স্বল্প মজুরি’র শ্রমিকদের তৈরি করা পোশাকের প্রচার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ব্র্যান্ডিং বিশেষজ্ঞ হিসেবে ২ মিলিয়ন পাউন্ড উপার্জন করা লিনেকার বিতর্কের পর থেকে টেলিভিশনে উপস্থাপনার সময় তার নেক্সট রেঞ্জ থেকে আর কোনো পোশাক পরেননি।
দুই সপ্তাহের অনুসন্ধানের পর ডেইলি মেইল লিনেকারের পরা জ্যাকেটটি খুঁজে পেয়েছে। জানা যায় গাজীপুরের অ্যাপটেক গ্রুপের কারখানায় এই পোশাকটি তৈরি করা হয়েছে।
ডেইলি মেইল’কে কারখানাটিতে কাজ করা ছয় শ্রমিকের মধ্যে চারজন নিশ্চিত করেছেন, টেলিভিশনে সাবেক ফুটবলার লিনেকারের পরা সবুজ জ্যাকেটটি তাদের কারখানাতেই তৈরি হয়েছে।
অ্যাপটেক ব্যবসায়িক স্যুট তৈরি করে থাকে।
কারখানাটির বেশিরভাগ শ্রমিক সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করেন। পাশাপাশি তারা ওভারটাইমও করেন (নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বেশি কাজ করেন)। কারণ তাদের মাসিক মজুরি সাড়ে ১৩ হাজার টাকা।
এই শ্রমিকদের অনেকেই কারখানা ভবনের কাছেই টিনের চালার একটি বাড়িতে বাস করেন। যেখানে তাদের রান্নাঘর ও শৌচাগারও মিলেমিশে ব্যবহার করতে হয়।
ডেইলি মেইলের সাথে কথা বলার সময় এক শ্রমিক তিন মাস আগে জ্যাকেটের ভেতরের পকেটটি সেলাই করার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আছেন যারা জ্যাকেটটি তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। ’ তিনি বলেছেন, ‘এই ধরনের সমস্ত জ্যাকেট আমার হাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। যদি ২ হাজার জ্যাকেট তৈরি হয়ে থাকে, তার সবগুলোতেই আমার ছোঁয়া আছে। ’
কারখানার শ্রমিকরা আরও বলেছেন, তাদের সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। তারা ঘণ্টায় ৬০ টাকা আয় করে থাকেন।
নারী শ্রমিকরা দাবি করেছেন, অ্যাপটেক কারখানার শ্রমিকদের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলেও সিলিং ফ্যানের নীচে তীব্র গরমের মধ্যেই কাজ করতে হয়।
ডেইলি মেইলের সাথে কথা বলা এক নারী শ্রমিক দাবি করেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাজের সময় তাদেরকে গালিগালাজও করে থাকেন।
যদিও অ্যাপটেক গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার দাবি করেছেন, তাদের কারখানা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরিই শ্রমিকদের প্রদান করে থাকে। তিনি আরও দাবি করেছেন, তাদের কর্মীরা বর্তমান মজুরি নিয়ে সন্তুষ্ট। সেই সাথে অতিরিক্ত গরমে কাজ করানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি। আরও জানিয়েছেন, বাজে আচরণের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। নিরাপদ ও সম্মানজনক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
২০১২ সালে বিবিসির স্পোর্টস রিলিফের জন্য একটি ফিল্ম তৈরি করার সময় লিনেকার বাংলাদেশ সফর করেন। সেসময় শত একর জমি জুড়ে বিস্তৃত আবর্জনার স্তূপ থেকে শিশুদের প্লাস্টিকের টুকরো সংগ্রহ করতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
ইউরো ২০২৪ পডকাস্টের এই হোস্ট বলেছেন, ‘এটি আমার দেখা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস। নরকে স্বাগতম। ’ তার সফরের পরে, তিনি সানডে টাইমসকে বলেন, ‘আমি এর আগেও দরিদ্র দেশগুলি সফর করেছি, তবে এটি আরও ব্যক্তিগত ছিল। এটা খুব চলন্ত ছিল। ”
ইউনাইটেড গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের খাদিজা খাতুন ডেইলি মেইলকে বলেছেন, ‘লিনেকারের উচিত তার প্রভাব প্রয়োগ করে এটা নিশ্চিত করা যে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা তাদের কাজের জন্য আরও বেশি মজুরি পান। ’ তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সমস্যা হল যে কেউ আসলে এটা (এই মজুরি) দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। লিনেকারের আবার বাংলাদেশ সফর করা উচিত বলেও মনে করেন খাদিজা। তিনি চান এই আয়ে যাদের সংসার চলে তাদের জীবন মান লিনেকারকে স্বচক্ষে দেখাতে।
সূত্রঃ ডেইলি মেইল
এম.কে
০৪ জুলাই ২০২৪