17.7 C
London
August 19, 2025
TV3 BANGLA
আন্তর্জাতিক

বাতিল হচ্ছে নাগরিকত্ব, ভারতীয় মুসলিমরা অস্তিত্ব সংকটে

প্রতি বছর আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ইতিহাসের সেই প্রতিশ্রুতিগুলোকে মনে করিয়ে দেয়, যা ১৯৪৭ সালের ভয়াবহ ও রক্তাক্ত দেশভাগের সময় দেওয়া হয়েছিল। সেই বিভাজনের পরও প্রায় সাড়ে তিন কোটি মুসলমান পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতেই থেকে গিয়েছিলেন, এই বিশ্বাসে যে, স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসেবে তারা সমান অধিকার, ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ভোগ করবেন। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের একটি প্রতিবেদনে সেই প্রত্যাশা ও বর্তমান পরিস্থিতির বৈপরীত্য তুলে ধরা হয়েছে।

বর্তমানে ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটিতে পৌঁছেছে, যা বিশ্বে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার পর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৬০ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমানের আবাসস্থলে পরিণত হবে।

তবে সংখ্যায় বিশাল হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন। চল্লিশের দশকে মুসলিম লীগ যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল—যে ‘হিন্দু কংগ্রেস’-এর শাসনে মুসলমানরা বৈষম্য, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং টার্গেটেড সহিংসতার শিকার হবে—আজ যেন সেই সতর্কবাণী বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মূল প্রতিশ্রুতি ভেঙে পড়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাশ হওয়ার পর। এই আইন প্রথমবারের মতো নাগরিকত্বের জন্য ধর্মকে একটি মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, যার পর থেকেই দেশজুড়ে ধর্মীয় বিভাজন আরও স্পষ্ট হতে থাকে।

কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলার পর তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী’ বিরোধী অভিযান আরও জোরদার হয়েছে। গুজরাট, দিল্লি, মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী দরিদ্র মুসলমানদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের বিচারকের সামনে হাজির করার আইনগত নিয়মও উপেক্ষা করা হচ্ছে।

নাগরিকত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে মুসলিমদের জন্য কঠোর কাগজপত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেখানে অমুসলিমদের জন্য একই নিয়ম শিথিল রাখা হয়েছে। এর ফলে কোটি কোটি দরিদ্র মুসলমান ভোটাধিকার হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। অথচ কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও অমুসলিমরা নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন।

এই পরিস্থিতিতে বিহারে আট কোটি ভোটারের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের ইঙ্গিত, এর ফলে বিপুলসংখ্যক মুসলমান ভোটারকে ‘অবৈধ’ হিসেবে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে।

ধর্মীয় বিদ্বেষ এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। কর্ণাটকে হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠীর নেতাদের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রধান শিক্ষককে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে স্কুলের পানির ট্যাংকে বিষ মেশানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি উবার চালক বা ডেলিভারি কর্মীরাও নির্দিষ্ট ধর্মীয় স্লোগান না দিলে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন।

১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সতর্ক করেছিলেন যে, ঐক্যবদ্ধ ভারত মানে মুসলমানদের জন্য দাসত্ব এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য। অন্যদিকে, জওহরলাল নেহেরু তার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রায় ৪০০টি চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে লিখেছিলেন যে, মুসলিমদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভারতের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক বক্তব্যে মুসলমানরা সরাসরি আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন যে, কংগ্রেস তাদের সুবিধা দিতে চায় এবং হিন্দু নারীদের ‘মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়ার’ পরিকল্পনা করছে। তবে এই ধরনের আক্রমণাত্মক প্রচারণার পরেও বিজেপি ফয়েজাবাদ-অযোধ্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ আসনে হেরে যায়।

বর্তমানে ভারতের মুসলমানরা নিজেদের দেশেই নিজেদের বহিরাগত হিসেবে গণ্য হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা, সাংস্কৃতিক অধিকার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মতো প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। বহু মুসলমানের কাছে এটি আর কোনো তাত্ত্বিক ভয় নয়, বরং প্রতিদিনের এক কঠিন বাস্তবতা। ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেই মূল প্রতিশ্রুতি, যার ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

সূত্রঃ টিআরটি ওয়ার্ল্ড

এম.কে
১৯ আগস্ট ২০২৫

আরো পড়ুন

কৃত্রিম মিষ্টিকে ক্যান্সারজনক ঘোষণা করলেও সমস্যা হবে না কোকাকোলার

নিউজ ডেস্ক

রাশিয়ায় শ্বাসরোধ করে খুন স্পুটনিক ভি টিকার অন্যতম কারিগরকে

নিউজ ডেস্ক

রসায়নে নোবেল পেলেন তিন গবেষক