মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে অনেকটাই নাকাল ইউরোপ। কোনো না কোনোভাবে প্রতিটি ব্যক্তির ওপরই পড়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব। তবে বিবাহিত ও পরিবারের সঙ্গে থাকা ব্যক্তির তুলনায় অবিবাহিত বা একাকী ব্যক্তির ওপর চাপের পরিমাণ অনেক বেশি। রেস্তোরাঁ থেকে বাসা ভাড়া পর্যন্ত বিবাহিতরা যে সুবিধা পাচ্ছেন, তা থেকে বঞ্চিত সিঙ্গেল ব্যক্তিরা। তাদের ব্যয়ের এ বোঝাকে আজকাল ‘সিঙ্গেল ট্যাক্স’ শব্দে অভিহিত করা হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যসহ সমগ্র ইউরোপের সিঙ্গেলরা কয়েক বছর ধরেই জুটি বা পরিবারের তুলনায় বেশি ব্যয় করছেন। অর্থাৎ যারা বিয়ে করেনি বা পারিবারিক পরিবেশে থাকেন না, চলমান অনিশ্চয়তার মাঝে তাদের খরচে যুক্ত হয়েছে বাড়তি অভিঘাত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদন অনুসারে, ইইউভুক্ত দেশগুলোয় সন্তান ও পরিবারহীন ব্যক্তিদের ব্যয় ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২২ সাল নাগাদ বেড়েছে ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ। লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশে একা থাকার নজির বেশি। ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রাপ্তবয়স্ক একা থাকা ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ১৯ লাখ।
বিয়ে ও পরিবারবিষয়ক থেরাপিস্ট সোফি ক্রিস বলেন, ‘সিঙ্গেল ট্যাক্সের প্রভাব অর্থনৈতিক হিসাবকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সম্পর্ক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভাবিত হতে পারে। সম্পর্কে থাকা মানুষের জন্য সুবিধা বাড়ার কারণেই মূলত অবিবাহিত ও একা থাকা মানুষের জন্য চাপ বেড়েছে। সেটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুদিক থেকেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘কেউ কেউ এর মধ্যেই মনে করতে শুরু করছেন, তারা একা থাকার বোঝা টানতে পারবেন না। সিঙ্গেল ট্যাক্সের কারণে তারা এখন সামাজিকভাবে অনেকটাই একা হয়ে পড়েছেন। কারণ সমাজ নানাভাবে পরিবার ও বিবাহিতদের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে একা থাকা ব্যক্তিদের জন্য বাসা ভাড়া কিংবা মর্টগেজ পরিশোধ করা অনেকটাই কঠিন। বিশেষ করে লন্ডনের মতো ব্যয়বহুল শহরে। এ কারণেই অনেক মানুষই যৌথ সম্পর্ক খারাপ হলেও আলাদা হতে পারছে না। কারণ তাদের এ আত্মবিশ্বাস নেই যে একা থাকলে জীবনধারণের উচ্চ ব্যয় মেটাতে পারবেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও একা ব্যক্তিদের ঋণ দেয়ার প্রতি ততটা আগ্রহী নয়। এমনকি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক কাঠামোর অধিকারী হলেও ঋণের বাজারে তাদের মূল্যায়ন কম। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে ভালো চাকরি ও মর্টগেজ রেকর্ড তেমন কোনো কাজে আসছে না। এ কারণে সিঙ্গেলদের বাড়ি কেনা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খুচরা পণ্যের বাজারেও হিমশিম খেতে হয় একা ব্যক্তিদের। কারণ মিনি প্যাকের তুলনায় ফ্যামিলি প্যাক অনেকটাই সাশ্রয়ী। চিপস থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁয় খাওয়া, সব ক্ষেত্রেও একাকীদের তুলনায় পরিবার ও জুটিরা বেশি সুবিধা পায়।
৩৮ দেশের জোট অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বেলজিয়ামে সন্তানহীন একক ব্যক্তির ওপর কর ৫৩ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৭ দশমিক ৮, অস্ট্রিয়ায় ৪৬ দশমিক ৮, ফ্রান্সে ৪৭ ও ইতালিতে ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বিপরীতে দুই সন্তানের পরিবারে বেলজিয়ামে কর ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৩২ দশমিক ৯, অস্ট্রিয়ায় ৩০ দশমিক ২, ফ্রান্সে ৩৯ দশমিক ২ ও ইতালিতে ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে ভ্রমণ ব্যয় বেড়ে চলেছে। এখানেও একা ভ্রমণের চেয়ে পরিবারগুলো বিভিন্ন ছাড় পায়। হোটেলে থাকা কিংবা ছুটির দিন উপভোগের জন্য সিঙ্গেলদের গুনতে হয় বাড়তি অর্থ। বিদ্যুতের বিল বা ওটিটি প্লাটফর্ম, সবক্ষেত্রেই পরিবারের সুবিধা বেশি। মুদিপণ্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই একই অবস্থা।
সূত্রঃ ইউরো নিউজ
এম.কে
১২ মার্চ ২০২৪