প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে সহিংসতা চলেছে যুক্তরাজ্যের লেস্টার শহরে। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সমর্থকদের সংঘর্ষের মাধ্যমে এই সহিংসতার সূত্রপাত। এরপর তা রূপ নেয় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। এদিকে সাম্প্রদায়িক মিলনের জন্য এই শহর প্রসিদ্ধ। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ কাধে কাধ মিলিয়ে বসবাস করছেন শহরটিতে। তাই এখানে এমন সহিংসতার ঘটনা হতবাক করে দিয়েছে সবাইকে।
বর্তমানে লেস্টার শহরে দক্ষিণ এশীয় জনগণের অনুপাত সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভারত উপমহাদেশ থেকে বহু মানুষ ইংল্যান্ডের এই শহরটিতে পারি জমাতে শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়াকে দুই ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীন করা হয়। ওইসময় উপমহাদেশে ব্যাপক আকারে ধর্মীয় সহিংসতা ছড়িয়ে পরেছিল। ১৯৪৮ সালের ব্রিটিশ জাতীয়তা আইনে প্রত্যেক কমনওয়েলথ নাগরিককে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়।
নতুন আগতদের মধ্যে অনেকেই উত্তর এবং পূর্ব লেস্টারে স্পিনি হিল পার্ক এবং বেলগ্রেভ রোডের আশেপাশে সাশ্রয়ী মূল্যের ব্যক্তিগত আবাসনে বসবাস শুরু করেন। আগতদের বেশিরভাগই এসেছিল পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে। তারা ছিল হিন্দু, শিখ ও মুসলিম ধর্মের এবং উপমহাদেশের ধর্মীয় সহিংসতার ভয়ংকর রূপ দেখেছিল। লেস্টারে প্রায়ই বৈষম্য দূর করতে প্রচারণা চালায় ভারতীয় শ্রমিক সংগঠন এবং সমতার জন্য একসঙ্গে কাজ করে।
১৯৭১ সালের মধ্যে লেস্টারে দক্ষিণ এশীয়দের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এলাকায় ডানপন্থি জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ৮০ দশকে দক্ষিণ এশীয় ব্রিটিশরা সিটি কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রচারকে সবসময় স্বাগত জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। আনন্দের সঙ্গে ঈদ, পূজা ও বৈশাখী উদযাপন হয়ে আসছে শহরটিতে। সব মিলিয়ে এই শহরকে বলা যেতে পারে ধর্মীয়
সম্প্রীতির জন্য ‘মডেল সিটি’।
ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় দাঙ্গা ঘটলেও লেস্টারে এর প্রভাব দেখা যায়নি। কিন্তু এই সেপ্টেম্বর জুড়ে রানির মৃত্যুর খবরের পাশাপাশি উঠে এসেছে লেস্টারের সহিংসতার খবর, যা জনমনে আতংক সৃষ্টি করেছে।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ এখানে আগেও হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকেরা। তবে সে সহিংসতা এবারের মত গুরুতর আকার কখনো নেয়নি।
সাংবাদিকরা বলছেন, এবার শুধু স্থানীয়রা নয়, লেস্টারের আশপাশের অন্য শহরগুলো থেকেও লোকজন এসে সংঘর্ষে যোগ দিয়েছে, যা নজিরবিহীন।
সবশেষ এ ঘটনার শুরু সদ্যসমাপ্ত এশিয়া কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে গত ২৮শে অগাস্ট ভারত-পাকিস্তান যে ম্যাচটি হয়েছিল – সেখান থেকে।
ওই টুর্নামেন্টের দু দলের প্রথম ম্যাচটিতে ভারত পাকিস্তানকে হারায়। এর পর সেই বিজয় উদযাপন করতে লেস্টার শহরের বেলগ্রেভ, মেল্টন রোড ও শ্যাফটসবেরি এভিনিউ এলাকায় রাস্তায় নেমে আসে শত শত যুবক।
স্থানীয় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবরে বলা হয়, জনতার মধ্যে থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে শোনা যায়। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একদল লোক মিলে এক ব্যক্তির টি-শার্ট ছিঁড়ে ফেলছে এবং তার পর এই লোকটিসহ কয়েকজনকে মারধর করছে।
লেস্টারশায়ার লাইভ নামে একটি অনলাইন পোর্টালের রিপোর্টে বলা হয়, একজন পুলিশ কর্মকর্তাও এসময় জনতার হাতে আক্রান্ত হন।
সহিংস ঘটনার শুরু হয়েছিল প্রধানত: বেলগ্রেভ এবং স্পিনি হিল এলাকায়। এরপর থেকেই শুরু হয় ভারত ও পাকিস্তান সমর্থকদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং তা কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে চলতে থাকে।
এশিয়া কাপে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিতীয় একটি ম্যাচ ছিল ৪ সেপ্টেম্বর – যাতে পাকিস্তান ভারতকে হারায়। এর পর আবার সহিংসতা শুরু হয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে, আর পুলিশ সাতদিনে অন্তত ১৮ জনকে জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের সন্দেহে গ্রেফতার করে।
শনিবার ১৭ই সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতি আবার গুরুতর হয়ে ওঠে।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে গ্রিন লেন এলাকায় – যেখানে বেশ কিছু মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কাছেই একটি হিন্দু মন্দিরও আছে – সেখানে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল করে যাবার সময় ‘জয় শ্রীরাম’ বলে শ্লোগান দেয়।
চলতে থাকা এই নজিরবিহীন সহিংসতার পর লেস্টারের হিন্দু ও মুসলিম উভয় কমিউনিটির নেতারাই শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছেন।
লেস্টারভিত্তিক মুসলিম সংগঠনগুলোর ফেডারেশনের একজন নেতা সুলেমান নাগদি বিবিসিকে বলছিলেন, কিছু তরুণ আছে যারা খুবই অসন্তুষ্ট এবং তারা ক্ষতিকর ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমাদের এ বার্তা দিতে হবে যে এর অবসান হতেই হবে, এবং অভিভাবকদের দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি যেন তারা তাদের ছেলেদের সাথে কথা বলেন।”
লেস্টারের হিন্দু ও জৈন মন্দিরগুলোর প্রতিনিধি সঞ্জীব প্যাটেল বলছেন, সহিংসতা কোন সমাধান নয়, এখন শান্তির সময়।
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
এনএইচ