TV3 BANGLA
যুক্তরাজ্য (UK)

যুক্তরাজ্যে অভিবাসী পরিবারগুলোকে চাইল্ডকেয়ার ফান্ড থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছেঃ প্রতিবেদন

যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে এবং পরিবারগুলোকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে অভিবাসী ও শরণার্থী পরিবারভুক্ত হাজার হাজার শিশুকে সরকারি চাইল্ডকেয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, কারণ তাদের অভিভাবকদের অভিবাসন অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত সুবিধাবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, একটি প্রতিবেদন এমনটাই জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “পাবলিক ফান্ডের কোনো অধিকার নেই” (NRPF) নীতির আওতায় থাকা অভিভাবকরা ৩০ ঘণ্টার বিনামূল্যের চাইল্ডকেয়ার সুবিধা পান না। ফলে তাদের কাজের পরিবর্তে শিশুদের দেখাশোনা করতে বাড়িতে থাকতে হয়। এতে পরিবারগুলো আরও দারিদ্র্যের মুখে পড়ছে এবং তাদের শিশুরা অন্যান্য শিশুদের মতো প্রারম্ভিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না।

Institute for Public Policy Research (IPPR) এবং মানবাধিকার সংস্থা Praxis-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ NRPF নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে প্রায় ৭১,০০০ পরিবার রয়েছে, যারা আয়-সংক্রান্ত শর্ত পূরণ করলেও শুধুমাত্র NRPF নীতির কারণে সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার বিনামূল্যের চাইল্ডকেয়ার সুবিধা পান না। কারণ এই নীতি তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুবিধা গ্রহণে বাধা দিচ্ছে।

প্রতিবেদনটি যুক্তি দিয়েছে যে, চাইল্ডকেয়ার সুবিধার এই নীতি সবচেয়ে বেশি দুর্বল অবস্থানে থাকা পরিবারগুলোকেই বাদ দিচ্ছে, যদিও সরকার তার ইশতেহারে প্রতিটি শিশুর জন্য সমান সুযোগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

NRPF-এর আওতায় থাকা পরিবারগুলো তিন ও চার বছরের শিশুদের জন্য মাত্র ১৫ ঘণ্টার বিনামূল্যের চাইল্ডকেয়ার সুবিধা পেতে পারে, এবং কিছু নিম্ন-আয়ের পরিবার তাদের দুই বছরের শিশুর জন্য চাইল্ডকেয়ার সুবিধা পেতে পারে। তবে তারা কোনো ধরনের অতিরিক্ত চাইল্ডকেয়ার সহায়তা পায় না, যেমন কর্মজীবী অভিভাবকদের জন্য বাড়তি সুবিধা, ইউনিভার্সাল ক্রেডিটের চাইল্ডকেয়ার সহায়তা, কিংবা ট্যাক্স-ফ্রি চাইল্ডকেয়ার সুবিধা।

বাংলাদেশ থেকে স্কিল্ড ওয়ার্কার ভিসায় তিন বছর আগে লন্ডনে আসা শামস সরকার জানিয়েছেন, তার যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া দুই বছরের মেয়েটি অন্যান্য শিশুদের মতো সরকার-প্রদত্ত চাইল্ডকেয়ার সুবিধা পাচ্ছে না।

ফলে তিনি এবং তার স্ত্রী পালাক্রমে বাসায় থেকে মেয়ের দেখাশোনা করছেন, যার ফলে তাদের কাজের সময় ও আয়ের পরিমাণ কমে গেছে। অন্যদিকে, তার মেয়ে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মিশে শেখার সুযোগ হারাচ্ছে।

শামস সরকার বলেন, “আমরা কোনো সুবিধা পাই না এবং আমাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়, তা মেনে নিয়েছি। কিন্তু অন্তত শিশুদের সমান অধিকার দেওয়া হোক। আমি ভেবেছিলাম, সব শিশুর জন্য নিয়ম একই হবে। কিন্তু আমার সন্তান এমন কিছু সুবিধা পাচ্ছে না, যা এখানে জন্ম নেওয়া অন্য শিশুরা পাচ্ছে।”

IPPR এবং Praxis ১৫৯ জন অভিভাবকের ওপর জরিপ চালিয়েছে, যাদের অন্তত একজন স্কুল-পূর্ব বয়সী শিশু রয়েছে এবং যারা NRPF বিধিনিষেধের আওতায় পড়েছে।

তারা দেখেছে—

°৫৫% অভিভাবক কোনো না কোনোভাবে চাইল্ডকেয়ার ব্যবহার করেছেন, যেখানে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার ৭২%।

°যারা চাইল্ডকেয়ার ব্যবহার করেছেন, তাদের ৩৬% আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক চাইল্ডকেয়ার সুবিধা নিয়েছেন।

°৪১% অভিভাবক বলেছেন, বিনামূল্যের চাইল্ডকেয়ার সুবিধার অভাব তাদের বা তাদের সঙ্গীকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।

IPPR-এর জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. লুসি মোর্ট বলেন, “চাইল্ডকেয়ার সুবিধা না থাকায় অভিভাবকরা কাজ করতে পারছেন না, পরিবারগুলো আরও দারিদ্র্যের মুখে পড়ছে এবং শিশুরা গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই অন্যায্য বাধা দূর করা হলে অভিভাবকদের কর্মসংস্থান সুবিধা মিলবে এবং প্রতিটি শিশু ভালোভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।”

Praxis-এর নীতিনির্ধারক কর্মকর্তা ও প্রতিবেদনের সহ-লেখক জোসেফিন হুইটাকার-ইলমাজ বলেন, “যদি সরকার সত্যিই চায় যে বেশি সংখ্যক শিশু স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠুক, তাহলে চাইল্ডকেয়ার খরচের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। এতে আমাদের সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উপকার হবে।”

IPPR-এর আরেকটি পৃথক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে অভিবাসী অভিভাবকদের সন্তানদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে, যেখানে অন্যান্য শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ২৫%।

প্রতিবেদনটি পূর্বাভাস দিয়েছে যে, আগামী বছরে প্রকাশিত হতে যাওয়া শিশু দারিদ্র্য নীতি ব্যর্থ হবে, যদি এটি যুক্তরাজ্যের বাইরের জন্ম নেওয়া অভিভাবকদের সন্তানদের দারিদ্র্যের সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়।

দুই সন্তানের মা হাফসা, যিনি স্কিল্ড ওয়ার্কার ভিসায় যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, বলেন—
“আমি আমার সন্তানদের জন্য কাপড় পর্যন্ত কিনতে পারি না। আমি তাদের জন্য জুতা কিনতে পারি না, এমনকি একটি খেলনাও কিনতে পারি না। মাসের শেষের ১০ দিনে খাবার কিনতে আমার সমস্যা হয়।”

যুক্তরাজ্যের শিক্ষা বিভাগ (Department for Education) এর এক মুখপাত্র বলেন—
“প্রতিটি শিশুকে জীবনের সর্বোত্তম শুরু দেওয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ্য, যাতে পটভূমির ভিত্তিতে সাফল্যের অন্যায্য বিভাজন দূর করা যায়। আমাদের ‘পরিবর্তনের পরিকল্পনা’র মাধ্যমে আমরা রেকর্ড সংখ্যক শিশুকে স্কুল-পূর্ব শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করব।”

তিনি আরও বলেন, “অর্থনীতির ভিত্তি ঠিক করতে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলেও, আমরা স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী স্কুল-ভিত্তিক নার্সারিগুলোর জন্য £১৫ মিলিয়ন বিনিয়োগের অগ্রাধিকার দিয়েছি।”

তবে, তিনি স্বীকার করেছেন যে, NRPF-এর আওতায় থাকা অভিভাবকরা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে দুই বছর বয়স থেকে সপ্তাহে ১৫ ঘণ্টার চাইল্ডকেয়ার সুবিধা পান এবং সরকার চাইল্ডকেয়ার সুবিধা আরও ন্যায়সংগত ও সহজলভ্য করতে কাজ চালিয়ে যাবে।

সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান

এম.কে
০৭ মার্চ ২০২৫

আরো পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার মতো অফশোর আশ্রয়কেন্দ্র যুক্তরাজ্যের জন্য যে কারণে বিপজ্জনক

নিউজ ডেস্ক

যুক্তরাজ্যে এপ্রিল মাস হতে বাড়তে চলেছে সাতটি বিল

দক্ষ শরণার্থীদের ৫ বছরের ওয়ার্ক ভিসা দিবে যুক্তরাজ্য