স্টুডেন্ট ভিসার নামে তৎপর হয়ে উঠেছে ভয়ংকর সব প্রতারক চক্র। ভুয়া কাগজপত্র বানায়ে প্রলোভন দেখিয়ে বিলেত যাওয়ার প্যাকেজ তৈরি দিচ্ছেন তারা। আর এই প্রতারকদের কারণে জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
এমনই ভয়ংক প্রতারণার কাহিনী নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে সিলেট প্রতিদিন। প্রতিবেদনে বলা হয়-
স্টুডেন্ট ভিসায় স্বপ্নের দেশ লন্ডনে যাবেন আফরোজা রহমান। এজন্যে সকল প্রস্তুতি নেন। একসময় আফরোজার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে ‘স্টেলার কনসালটেন্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মুনতাসির মাহবুব আফরোজার ফাইলপত্র ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনে ভিসার জন্যে প্রসেসিং করেন। তৈরি করেন জব সার্টিফিকেটও। ইউনিভার্সিটি অব দ্যা ওয়েস্ট অফ ইংল্যান্ড (সংক্ষেপে ইউডাব্লিউই), ব্রিস্টলে পড়াশোনা করতে যুক্তরাজ্যের ভিসা পেতে পাসপোর্টসহ ফাইলপত্র জমা দেন। ভিসা দূরে থাক, আফরোজাকে ডক্যুমেন্ট জালিয়াতির জন্যে ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেয় ব্রিটিশ হাইকমিশন। কেবল আফরোজা রহমান-ই নয়; এভাবে ১৯ জন মেধাবী শিক্ষার্থী জব সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন। মুনতাসির মাহবুবের দেয়া জাল ডক্যুমেন্টের কারণে এখন তাদের সামনে কেবলই অন্ধকার।প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে স্টুডেন্ট ভিসার নামে এমন ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতারিত শিক্ষার্থীরা মাহবুব ও তার স্ত্রীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করলেও তারা কৌশলে বের হয়ে গেছে।
প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্টুডেন্ট ভিসার জন্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুতে ১৯ শিক্ষার্থীর পাসপোর্টসহ ফাইলপত্র ভিএফএস- এ জমা দেয়া হয়। সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারের ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড শপিং সিটির (লিফটের -৪) ৫ম তলায় অবস্থিত ‘স্ট্রেলার কনসালটেন্ট’র ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মুনতাসির মাহবুব সবকটি ফাইল প্রসেসিং করে জমা দেন। ফাইলে জব সার্টিফিকেট হিসেবে আর.এম. গ্রুপের জব সার্টিফিকেটও দেয়া হয়। পাসপোর্ট জমা দেয়ার মাসখানেক পরে ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে শিক্ষার্থীদেরকে ই-মেইল পাঠানো হয়। ই-মেইল করে ব্রিটিশ হাইকমিশন জানায়, ভুয়া ডক্যুমেন্ট দেয়ায় ১০ বছরের জন্য তাদের ব্যান্ড (নিষেধাজ্ঞা) করা হয়েছে। ফাইলে দেয়া জব সার্টিফিকেটটি একেবারেই ভুয়া। একসাথে ১৯ শিক্ষার্থীকে ব্যান্ড বা নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। মুনতাসির মাহবুব শিক্ষার্থীদেরকে ভিসা পাইয়ে দিতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে রিভিউ করেন। জুলাইয়ের শুরুতে রিভিউ এর ফলাফল জানায়, ব্রিটিশ হাইকমিশন। এবার হাইকমিশন জানায়, শিক্ষার্থীদের জব সার্টিফিকেটের সত্যতা নিশ্চিত হতে ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে সরাসরি আর.এম গ্রুপে খোঁজ নেয়া হয়। সরেজমিন গিয়ে জব সার্টিফিকেটগুলোর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। রিভিউয়েও ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে ব্রিটিশ হাইকমিশন।
সূত্র জানায়, স্টুডেন্ট ভিসার জন্যে জব সার্টিফিকেটের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে, স্টাডি গ্যাপ (শিক্ষায় বিরতি) হলে অনেকক্ষেত্রে জব সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়।
সহজভাবে ভিসা পেতে জব সার্টিফিকেট নিজে থেকে তৈরি করে দেন মুনতাসির মাহবুব। শিক্ষার্থীদের প্রবল আপত্তির মুখে মুনতাসির মাহবুব জব সার্টিফিকেটগুলো তৈরি করে দেন বলে তিনি নিজেও লিখিত দিয়ে স্বীকার করেন। অথচ, শিক্ষার্থীরা আর. এম গ্রুপের এই জব সার্টিফিকেট না দেয়ার জন্যে একাধিকবার বাধা দিয়েছিলেন।
স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডন যেতে ১৯ শিক্ষার্থী মুনতাসির মাহবুবের মাধ্যমে ১ লাখ ৯ হাজার ৭৫০ পাউন্ড জমা দেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টাকা। এর মধ্যে এক ছাত্রী ১০ হাজার পাউন্ড, আরেকজন ৮ হাজার পাউন্ড, অন্যজন ৭ হাজার পাউন্ড, ৫ হাজার পাউন্ড, ৬ হাজার পাউন্ড করে বিপুল পরিমাণের এই অর্থ দেন। স্টুডেন্ট ভিসায় চলে যাবেন লন্ডন এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন ১৯ শিক্ষার্থী। দেশে সরকারি – বেসরকারি কোনো চাকুরির চেষ্টা বা দেশেই উচ্চতর পড়ারও কোনো চেষ্টা না করে সবাই ছুটছিলেন কেবল স্টুডেন্ট ভিসার প্রত্যাশায়। কিন্তু, ভিসা পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ায় এখন তাদের সামনে কেবলই অন্ধকার। প্রতারণার শিকার শিক্ষার্থীরা এখন কি করবেন তা বুঝে উঠতেও পারছেন না। ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ায় নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা। তাদের সামনে এখন কেবলই অন্ধকার। কি করবেন তাও ভেবে পাচ্ছেন না তারা। ১০ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকায় লন্ডনের বাইরে ইউরোপ, কানাডা বা আমেরিকার ভিসা পাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
১৩ ডিসেম্বর ২০২১
এনএইচ
সূত্র: সিলেট প্রতিদিন