ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করা হলে, বিশ্বাস হয়নি অনেকের। আশাবাদীর তুলনায় সন্দেহপোষণকারীর সংখ্যা ছিল বেশি। মরুভূমির মধ্যে ফুটবল বিশ্বকাপ কিভাবে সম্ভব? এতো গরমে ফুটবল খেলা তো দূরের কথা, খেলা দেখাও কষ্টকর হয়ে উঠবে। কারণ সেদেশের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। অন্যান্য অনেক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি দর্শক ও খেলোয়ারদের ঠাণ্ডা রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিতে হয়েছে আয়োজকদের। আর এই চ্যালেঞ্জ সমাধানে যে অভিবন কৌশলটি ব্যবহার হবে তা প্রকাশে এসেছে।
ওই এলাকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা খেলার জন্য বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। সমুদ্র থেকে গরম হাওয়া ছোট এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
তাই প্রথম চ্যালেঞ্জ হল গরম বাতাস বের করে দেয়া। একারণে আল জানউব স্টেডিয়ামের ছাদ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে বাতাস এই স্টেডিয়ামের চারপাশ দিয়ে এবং ছাদের খোলা অংশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ছাদের রঙও হালকা রাখা হয়েছে যাতে সূর্যের আলো তাতে প্রতিফলিত হয় এবং ছাদ শীতল রাখে।
পিচ এবং স্ট্যান্ডগুলো ঠাণ্ডা রাখার জন্য আরও কিছু উদ্ভাবনী সমাধান নেয়া হয়েছে।
খেলার সময় স্টেডিয়ামের ভেতরে ৪০ হাজারের বেশি লোক জড়ো হবে। আর প্রতিটি মানুষের শরীর থেকে তাপ আর আর্দ্রতা তৈরি হবে। তাই পিচ ও দর্শক স্ট্যান্ডগুলোর জন্য একটা কার্যকর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজন।
সে কারণে, ফুটবল দর্শকদের প্রত্যেকের আসনের নিচে ভেন্টিলেটার বসিয়ে সেখান দিয়ে হাওয়া চালিয়ে আসন শীতল রাখা হবে। শাওয়ারের ছিদ্র দিয়ে যেভাবে পানির ধারা বেরোয়, একইরকম সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়া হবে। বাতাসের এই প্রবাহ হবে খুবই মৃদু এবং এই বাতাস দর্শকদের চারপাশ থেকে ঘিরে রাখবে।
কিন্তু পিচে খেলোয়াড়দের অবস্থা কেমন হবে?
একটা ফুটবলে ম্যাচ খেলার সময় একজন খেলোয়ার ১০ কিলোমিটারের বেশি দৌড়ান, ফলে তাদের শরীর থেকে তিন লিটার পর্যন্ত ঘাম নির্গত হয়। কাজেই তাদের শরীর ঠাণ্ডা করা এবং শরীরে পানির প্রয়োজন এদিকে কাতারের আবহাওয়া আর্দ্র, ফলে সেখানে ঘাম সহজে শুকায় না। ফলে শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যেতে পারে এবং অতি গরমে মানুষ অবসন্ন হয়ে পড়তে পারে।
বলা হচ্ছে, পিচের চারপাশ থেকে বড় ঝারিমুখ দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়া হবে। এতে পিচের উপরিভাগে শীতল আস্তরণ তৈরি হবে।
এই প্রযুক্তি তৈরিতে সহায়তা করেছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ ড. সাউদ আবদুল গানি বলছেন, ভেন্টগুলো বিশেষ অ্যাঙ্গেলে বসানো হয়েছে। ফলে ঠাণ্ডা বাতাস যেভাবে-যেখানে গিয়ে জমা হচ্ছে, তাতে খেলোয়াড়রা বুঝতেই পারবেন না যে একটা আলাদা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে।
এতে স্টেডিয়ামের ভেতর ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি তাপমাত্রার একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার বুদ্বুদ তৈরি হবে। আর সেটা কখনই মাটি বা আসনের স্ট্যান্ড থেকে দু’মিটারের বেশি ওপরে উঠবে না। আর মরুভূমির আবহাওয়ার সঙ্গে অসামঞ্জস্যও লাগবে না।
বুদবুদের ঠাণ্ডা বাতাস যখন আবার গরম হয়ে উঠবে, তখন নির্গমন ফ্যান ওই গরম বাতাস টেনে নিয়ে যাবে। এরপর ওই বাতাসকেই ফিল্টার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আবার শীতল করা হবে এবং স্টেডিয়ামে ফেরত পাঠানো হবে। এভাবেই বাতাসের চক্র সম্পূর্ণ হবে এবং খেলোয়ার-দর্শকরা স্বস্তিতে থাকবে।
বাতাস যেভাবে শীতল করা হবে?
স্টেডিয়ামের প্রতিটি কোণে বসানো আছে হিট এক্সচেঞ্জার। এগুলোর মধ্যে আছে শীতল পানি-ভর্তি পাইপ। গরম হাওয়া ওই পাইপগুলোর পাশে বসানো ফানেলের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করা হবে।
ঠাণ্ডা পানি বাতাসের তাপকে শুষে নেওয়ার পর সেখানে আবার শীতল পানির সরবরাহ প্রয়োজন। এদিকে মরুর দেশে পানি খুবই মূল্যবান। তখন পাম্পের মাধ্যমে ওই পানি চলে যাবে তিন কিলোমিটার দূরের ট্যাংকে। এই ট্যাংকেই পানি আবার শীতল করা হবে এবং পরের দিনের খেলায় স্টেডিয়াম ঠাণ্ডার কাজে ব্যবহার হবে।
পুরো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি চালানোর জন্য কাতারের রাজধানী দোহার থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির সাহায্যে।
কাতার বিশ্বকাপের আয়োজকরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, স্টেডিয়ামগুলো পুরোটা শীতল করতে যে জ্বালানি খরচ হবে, তা বাড়তি কোন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করবে না, কারণ এর জন্য বিদ্যুৎ আসবে নতুন বসানো সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। তাই এতে পরিবেশের ক্ষতি হবে না।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া ছিল কাতারের জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ। আর তা বাস্তবায়নে দেশটি যে অভিবন কৌশল ও পারদর্শিতা দেখিয়েছে তা অভাবনীয়। এরফলে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করে হরহামেশাই মরুভূমির দেশগুলোতে আয়োজন করা যাবে ফুটবলসহ অন্যান্য খেলার বড় বড় আসর।
৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
সূত্র: বিবিসি