যুক্তরাজ্যে সেবাকর্মীর ভিসায় আসা অভিবাসীরা ধর্ষণ ও শোষণের শিকার হয়েও চাকরি টিকিয়ে রাখতে চুপ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন৷ অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম দ্য ব্যুরো ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম- টিবিআইজি এবং আইনী সহায়তা দানকারী সংগঠন সিটিজেনস অ্যাডভাইস ব্যুরো দেড়শোরও বেশি অভিবাসীর কাছ থেকে এমন তথ্য সংগ্রহ করেছে৷ ভুক্তভোগীর প্রকৃত সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি বলে ধারণা তাদের৷
ব্রিটেনে স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মীর ভিসায় আসা ৮০টি প্রতিষ্ঠানের ১৭৫ জনের স্বাক্ষ্য নিয়েছে টিবিআইজি এবং সিটিজেনস অ্যাডভাইস৷ নিপীড়নের নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন তারা৷ ক্যারিবিয়ান দ্বীপ থেকে আসা একজন সেবা কর্মী জানান যে বাড়িতে কাজ করেন তার মালিকের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তিনি।
একজন জানিয়েছেন তাকে ২০ ঘণ্টা কাজ করানো হয়৷ নিয়োগদাতার কাছে অভিযোগ করার পর তার ভিসা প্রত্যাহারের হুমকি দেয়া হয়৷ নিয়োগদাতার হাতে একাধিকবার ধর্ষিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন আফ্রিকা থেকে ভুক্তভোগী এই সেবা কর্মী৷ তিনি এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে সহায়তাও চাননি৷ এক পর্যায়ে পেশাদার সম্পর্ক বজায় রাখতে বলায় নিয়োগদাতা তাকে কাজ দেয়াই বন্ধ করে দেন৷
সিটিজেনস অ্যাডভাইস জানিয়েছে, গত বছর তাদের কাছে স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের কর্মীদের সহায়তা চাওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে৷ সিটিজেনস অ্যাডভাইস ও টিবিআইজে তাদের সাক্ষাৎকারে যেসব অভিযোগ পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো: মজুরি চুরি করা, কাজ দেয়ার জন্য অবৈধভাবে ৩০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত নেয়া, কর্মঘণ্টার প্রতিশ্রুতি বজায় না রাখা, প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা এবং শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে তাদের থাকতে বাধ্য করা৷
তাদের অনেকে এরইমধ্যে খাবার, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য বিল পরিশোধের জন্য ঋণ করতেও বাধ্য হয়েছেন৷ অন্যদিকে ভিসার শর্তের কারণে বিপদে পড়া এই অভিবাসীরা সরকারি ভাতা বা বাসস্থানের সুবিধাটুকুও পান না৷
এই ভিসা পাওয়ার শর্ত হিসেবে আবেদনকারীর কাছে অবশ্যই অনুমোদিত কোনো নিয়োগদাতার পাঠানো চাকরির প্রস্তাব থাকতে হবে, যারা মূলত স্পন্সর নামে পরিচিত৷ শর্ত অনুযায়ী নিয়োগদাতা যুক্তরাজ্য পৌঁছানো মাত্রই তার কাজের ব্যবস্থা করবেন৷ কিন্তু ভিসা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তারা পুরোপুরি স্পন্সরকারীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন৷ ওয়ার্কার রাইটস সেন্টার নামের একটি সংস্থার প্রধান নির্বাহী ডোরা অলিভিয়া ভিকল জানান, এই ব্যবস্থাটির কারণে বিপদে পড়ার ভয়ে নিপীড়নের বিষয়ে কর্মীরা কর্তৃপক্ষের কাছেও অভিযোগ জানানোর সাহস পান না৷
ভিসাবিধির কারণে নানা জটিলতায় পড়েন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা৷ চাকরি ছাড়লে সরকারি কোনো ভাতা তাদের মেলে না৷ বরং চাকরি ছাড়ার মাত্র ৬০ দিনের মধ্যে নতুন কাজ যোগাড় ও পূণরায় ভিসা নিতে হয়৷ বাসস্থানের জন্যেও তাদেরকে নিয়োগদাতার উপর নির্ভর করতে হয়৷ কিছুক্ষেত্রে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে নিয়োগ ব্যয় পরিশোধেও তারা চুক্তিবদ্ধ থাকেন৷
সিটিজেনস অ্যাডভাইসের নীতি বিষয়ক পরিচালক কাইলে হিগনেল বলেন, ‘‘এই ব্যবস্থায় আনুমানিক কয়েক হাজার মানুষ আটকা পড়েছেন যারা নিপীড়ন, হুমকির মুখে ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, যাদের অভিযোগ জানানোর ক্ষমতা নেই এবং অনেক সময় কয়েক হাজার পাউন্ড লোকসানে পড়েন৷’’ ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘‘এই মানুষেরা দক্ষ পেশাজীবী যারা আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাটি চালু রাখছেন অথচ বিপদের সময় তাদেরই কোনো নিরাপত্তা নেই৷’’
এদিকে সোমবার ব্রিটিশ সরকার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে অপব্যবহারের কারণে এখন থেকে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা তাদের ভিসার আওতায় পরিবারের সদস্য বা নির্ভরশীলদের যুক্তরাজ্যে আনতে পারবেন না।
এক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছর এক লাখ ২০ হাজার ভিসার বিপরীতে তারা এক লাখ জনকে যুক্তরাজ্যে এনেছেন৷ এটিকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেছেন, ‘‘সেবাকর্মীরা আমাদের সমাজে অসামান্য অবদান রাখেন, প্রয়োজনের সময়ে আমাদের প্রিয়জনদের যত্ন নেন৷’’ কিন্তু এই ভিসার ‘স্পষ্ট অপব্যবহার ও কারসাজি’ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি তা চলতে দেয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন৷
নতুন নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা কোন অভিবাসীকে স্পন্সর করতে হলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা কেয়ার কোয়ালিটি কমিশনে নিবন্ধন করতে হবে৷
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
২৪ মার্চ ২০২৪