ক্যামেরায় এখন ফিল্মের রিল লাগে না। শত কিংবা হাজার গিগাবাইটের স্টোরেজ আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার, আলো নিয়ে আগে থেকে হিসাব করার দরকার নেই। ছবি তোলার পর ইচ্ছামতো ‘কালার কারেকশন’ করা সম্ভব। সে কারণে ফটোগ্রাফিতে ‘পোস্ট প্রসেসিং’ এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছবি তোলার হিসাবই বদলে গেছে। কেবল ছবি নয়, প্রযুক্তি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে শিল্পের নানা ক্ষেত্র।
ফটোগ্রাফির যে উদাহরণ দেয়া হলো সেটা প্রযুক্তি ব্যবহারের। এখানে আলোকচিত্রী বা ছবি সম্পাদনাকারীকে কমান্ড দিয়ে সম্পাদনা করতে হয়। এ পদ্ধতি গত দশকের। এ দশকে প্রয়োজন নেই এক এক করে কমান্ড দেয়ার। একটি কমান্ডেই ছবির ভুলত্রুটি শুধরে দিতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শোধরানোর পর্যায় পার করে এখন সে তৈরিই করতে পারে নানা ছবি, পেইন্টিং বা বিস্তৃত পরিসরে বলতে গেলে তৈরি করতে পারে একটি ‘আর্ট ওয়ার্ক’।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায় এআই দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নানা ছবি। এর মধ্যে কখনো থাকে বলিউড তারকাদের হলিউড চরিত্রে বসানো বস্তুত এসব চিত্র কোনো ব্যক্তি তৈরি করে না। ব্যক্তির দেয়া কিছু তথ্য নিয়ে ছবিগুলো তৈরি করে এআই। এর মধ্যে মিডজার্নি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ও নিখুঁত আর্ট ওয়ার্ক তৈরি করে দিতে পারে। এছাড়া আছে ডাল-ই।
এখন পর্যন্ত এআই শিল্পমাধ্যমে কাজ করার ক্ষেত্রে মানুষের সাহায্য নিচ্ছে। কাজগুলো কয়েকটি ধারায় হয়। এর মধ্যে আছে জেনারেল অ্যাডভার্সারিয়াল নেটওয়ার্কস (জিএএন), ইমেজ স্টাইল অ্যালগরিদম, কম্পিউটার এইডেড ড্রইং টুল, ইমেজ ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেমস ও আর্ট চ্যাটবট। পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ইমেজ স্টাইল অ্যালগরিদম বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। এ পদ্ধতিতে আর্ট তৈরি হয় দুটো ভিন্ন মাধ্যমে। একদিকে তৈরি হয় ছবি, অন্যদিকে থাকে স্টাইল। ফলে দুটো মিলে তৈরি হয় একটা স্বতন্ত্র আর্ট। ব্যক্তির পক্ষে এ স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য একত্রে আনা কঠিন।
এআই দিয়ে ছবি আঁকা বা আঁকানোর ক্ষেত্রে সাধারণ মানসে থাকা ধারণাটি হলো, কম্পিউটারকে কিছু রেফারেন্স দিলে সে ছবি তৈরি করে দেয়। মোটাদাগে বিষয়টি সত্য। এর ফলে আর্টের ধরন, ফর্ম, স্টাইল বদলে যাচ্ছে। কিন্তু এআই সম্পর্কিত আর্ট সবসময়ই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় না। আধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হওয়া এআই আর্টের ধারণাটি নতুন। তবে ডিজিটাল আর্ট কয়েক দশক ধরে চলছে। এখন যেকোনো ভালো স্মার্টফোন বা ট্যাবে অ্যাপ ব্যবহার করে ছবি আঁকা যায়। এসব ছবি মূলত ব্যক্তিই তৈরি করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে রঙ, ছবিতে ব্যবহৃত রেখাগুলো অনেকটাই অ্যাপ নিয়ন্ত্রিত বা বাছাইকৃত। বলা বাহুল্য, মোবাইল বা কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনও এআইয়ের অংশ।
সব মিলিয়ে এআই যে কাজটা করছে তা হলো ডিজিটাল আর্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেখানে ব্যক্তির নিজস্ব নিরীক্ষার জায়গা কমে যাচ্ছে। আর্ট আগে যতটা ‘ফিজিক্যাল’ ছিল এখন ততটাই হয়ে যাচ্ছে ‘আর্টিফিশিয়াল’। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। ভিঞ্চির মোনালিসা সুন্দর দুটো কারণে। প্রথমত, ভিঞ্চি যে সৌন্দর্য তাতে দিয়েছেন তা দর্শকের চোখের জন্য। দ্বিতীয়ত, একজন আর্টিস্ট বা গবেষকের জন্য। সেখানে আছে ভিঞ্চির ব্রাশ স্ট্রোক, রঙ ব্যবহারের মতো বিষয়গুলো। এআই আসার ফলে পুরনো দিনের শিল্পীদের মতো এখন আর রঙ নিয়ে গবেষণা হবে না। ওয়াটার কালার, অয়েল পেইন্টিংয়ে আলাদা ফর্মগুলো হারিয়ে যাবে। ক্যানভাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না তুলির কোনো সুতা।
এআই বিশ্লেষণ করতে পারে ছবিকে। সে জায়গা থেকে পুরনো জলরঙ, তেলরঙ, প্যাস্টেল বা গোয়াশে আঁকা ছবি বিশ্লেষণ করে এআই সে স্টাইলের আর্ট তৈরি করতে পারবে। কিন্তু সেটা তেলরঙ বা জলরঙে আঁকা ছবির মতো হবে, তেলরঙ বা জলরঙের ছবি হবে না। এছাড়া মিডজার্নিতে কমান্ড দিয়ে কোনো ক্যানভাস সামনে রাখা, তুলি হাতে ধরা বাদেই যে কেউ হয়ে যেতে পারবে একজন শিল্পী। ফটোগ্রাফি ও পেইন্টিংয়ের পার্থক্যও হয়তো চলে যাবে একসময়। একটাই আর্ট ফর্ম হবে—এআই আর্ট।
এম.কে
২৬ জুলাই ২০২৩